বঙ্গবাণী কবিতা – আবদুল হাকিম


বঙ্গবাণী
আবদুল হাকিম


কিতাব পড়িতে যার নাহিক অভ্যাস।
সে সবে কহিল মোতে মনে হাবিলাষ।।
তে কাজে নিবেদি বাংলা করিয়া রচন।
নিজ পরিশ্রম তোষি আমি সর্বজন।।
আরবি ফারসি শাস্ত্রে নাই কোন রাগ।
দেশী ভাষে বুঝিতে ললাটে পুরে ভাগ।।
আরবি ফারসি হিন্দে নাই দুই মত।
যদি বা লিখয়ে আল্লা নবীর ছিফত।।
যেই দেশে যেই বাক্য কহে নরগণ।
সেই বাক্য বুঝে প্রভু আপে নিরঞ্জন।।
সর্ববাক্য বুঝে প্রভু কিবা হিন্দুয়ানী।
বঙ্গদেশী বাক্য কিবা যত ইতি বাণী।।
মারফত ভেদে যার নাহিক গমন।
হিন্দুর অক্ষর হিংসে সে সবের গণ।।
যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।
দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়।
নিজ দেশ তেয়াগী কেন বিদেশ ন যায়।।
মাতা পিতামহ ক্রমে বঙ্গেত বসতি।
দেশী ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি।।


বিদ্যার মাহাত্ম্য কবিতা – হায়াত মাহমুদ


বিদ্যার মাহাত্ম্য
হায়াত মাহমুদ


যার বিদ্যা নাই সে না জানে ভালমন্দ।
শিরে দুই চক্ষু আছে তথাপি সে অন্ধ।।
সে চক্ষু বিদ্যার বিনে আর কারো নয়।
বিদ্যা বড় ধন নাহি শুন মহাশয়।।
বিদ্যাধন যে বা রাখে ধনী বলে তারে।
চোরে চুরি করিবারে সে ধন না পারে।।
যতেক খরচ করো তত সে বাড়য়।
খরচ করিলে ধন কম নাহি হয়।।
লোকের বিক্রম বাড়ে বিদ্যার বিধানে।
পশুতে অধম যেই বিদ্যা নাহি জানে।।
বিদ্যার মহিমা ভাই কহিতে না পারি।
বিদ্যা পড় বিদ্য শিখ শ্রম পরিহরি।।
যে ছেলে না জানে বিদ্যা গরু তাথে ভাল।
বনে ঘাস খায়া বয় গৃহস্থের হাল।।


স্বদেশীয় ভাষা কবিতা – রামনিধি গুপ্ত


স্বদেশীয় ভাষা
রামনিধি গুপ্ত


নানান দেশের নানান ভাষা।
বিনে স্বদেশীয় ভাষা,
পুরে কি আশা?
কত নদী সরোবর
কিবা ফল চাতকীর
ধারাজল বিনে কভু
ঘুচে কি তৃষা?


মোদের গরব, মোদের আশা কবিতা – অতুলপ্রসাদ সেন


মোদের গরব, মোদের আশা
অতুলপ্রসাদ সেন


মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা!
তোমার কোলে, তোমার বোলে, কতই শান্তি ভালবাসা!
কি যাদু বাংলা গানে!- গান গেয়ে দাঁড় মাঝি টানে,
এমন কোথা আর আছে গো!
গেয়ে গান নাচে বাউল, গান গেয়ে ধান কাটে চাষা।।

ঐ ভাষাতেই নিতাই গোরা, আনল দেশে ভক্তি-ধারা,
মরি হায়, হায় রে!
আছে কই এমন ভাষা, এমন দুঃখ-শ্রান্তি-নাশা!
বিদ্যাপতি, চণ্ডী, গোবিন, হেম, মধু, বঙ্কিম, নবীন-
আরও কত মধুপ গো!
ঐ ফুলেরি মধুর রসে, বাঁধলো সুখে মধুর বাসা।।

বাজিয়ে রবি তোমার বীণে, আনলো মালা জগৎ জিনে-
গরব কোথায় রাখি গো!
তোমার চরণ-তীর্থে আজি, জগৎ করে যাওয়া-
আসাওই ভাষাতেই প্রথম বোলে, ডাকনু মায়ে 'মা', 'মা' বলে;
ওই ভাষাতেই বলবো 'হরি', সাঙ্গ হলে কাঁদা-হাসা।।


অপব্যয়ের ফল কবিতা – কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার


অপব্যয়ের ফল
কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার


যে জন দিবসে মনের হরষে
জ্বালায় মোমের বাতি,
আশু গৃহে তার দেখিবে না আর
নিশীথে প্রদীপ ভাতি।


কাজের ছেলে কবিতা – যোগীন্দ্রনাথ সরকার


কাজের ছেলে
যোগীন্দ্রনাথ সরকার


'দাদখানি চাল, মুসুরির ডাল, চিনি-পাতা দৈ,
দু'টা পাকা বেল, সরিষার তেল, ডিম-ভরা কৈ।'
পথে হেঁটে চলি, মনে মনে বলি, পাছে হয় ভুল;
ভুল যদি হয়, মা তবে নিশ্চয়, ছিঁড়ে দেবে চুল।
'দাদখানি চাল, মুসুরির ডাল, চিনি-পাতা দৈ,
দু'টা পাকা বেল, সরিষার তেল, ডিম-ভরা কৈ।'
বাহবা বাহবা- ভোলা ভুতো হাবা খেলিছে তো বেশ।
দেখিব খেলাতে, কে হারে কে জেতে, কেনা হলে শেষ।
'দাদখানি চাল, মুসুরির ডাল, চিনি-পাতা দৈ,
ডিম ভরা বেল, দু'টা পাকা তেল, সরিষার কৈ।'
ওই তো ওখানে ঘুড়ি ধরে টানে, ঘোষেদের ননীঃ
আমি যদি পাই, তা হলে উড়াই আকাশে এখনি।
দাদখানি তেল, ডিম-ভরা বেল, দু'টা পাকা দৈ,
সরিষার চাল, চিনি-পাতা ডাল, মুসুরির কৈ!
এসেছি দোকানে-কিনি এই খানে, যদি কিছু পাই;
মা যাহা বলেছে, ঠিক মনে আছে, তাতে ভুল নাই!
দাদখানি বেল, মুসুরির তেল, সরিষার কৈ,
চিনি-পাতা চাল, দু'টা পাকা ডাল, ডিম-ভরা দৈ।


আমার পণ ছড়া – মদনমোহন তর্কালঙ্কার


আমার পণ
মদনমোহন তর্কালঙ্কার


সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি,
সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি।
আদেশ করেন যাহা মোর গুরুজনে,
আমি যেন সেই কাজ করি ভাল মনে।
ভাইবোন সকলেরে যেন ভালবাসি,
এক সাথে থাকি যেন সবে মিলেমিশি।
ভাল ছেলেদের সাথে মিশে করি খেলা,
পাঠের সময় যেন নাহি করি হেলা।
সুখী যেন নাহি হই আর কারো দুখে,
মিছে কথা কভু যেন নাহি আসে মুখে,
সাবধানে যেন লোভ সামলিয়ে থাকি,
কিছুতে কাহারে যেন নাহি দেই ফাঁকি।
ঝগড়া না করি যেন কভু কারো সনে
সকালে উঠিয়া এই বলি মনে মনে।

কপোতাক্ষ নদ কবিতা – মাইকেল মধুসূদন দত্ত


কপোতাক্ষ নদ
মাইকেল মধুসূদন দত্ত


সতত, হে নদ, তুমি পড় মোর মনে!
সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে;
সতত (যেমতি লোক নিশার স্বপনে
শোনে মায়া- মন্ত্রধ্বনি) তব কলকলে
জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে!
বহু দেশ দেখিয়াছি বহু নদ-দলে,
কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে?
দুগ্ধ-স্রোতোরূপী তুমি জন্মভূমি-স্তনে।

আর কি হে হবে দেখা?- যত দিন যাবে,
প্রজারূপে রাজরূপ সাগরেরে দিতে
বারি-রুপ কর তুমি; এ মিনতি, গাবে
বঙ্গজ জনের কানে, সখে, সখা-রীতে
নাম তার, এ প্রবাসে মজি প্রেম-ভাবে
লইছে যে নাম তব বঙ্গের সংগীতে।


রসাল ও স্বর্ণলতিকা কবিতা – মাইকেল মধুসূদন দত্ত


রসাল ও স্বর্ণলতিকা
মাইকেল মধুসূদন দত্ত


রসাল কহিল উচ্চে স্বর্ণলতিকারে;-
শুন মোর কথা, ধনি, নিন্দ বিধাতারে।
নিদারুণ তিনি অতি;
নাহি দয়া তব প্রতি;
তেঁই ক্ষুদ্র-কায়া করি সৃজিলা তোমারে।
মলয় বহিলে, হায়,নতশিরা তুমি তায়,
মধুকর- ভরে তুমি পড় লো ঢলিয়া;
হিমাদ্রি সদৃশ আমি,
বন-বৃক্ষ-কুল-স্বামী,
মেঘলোকে উঠ শির আকাশ ভেদিয়া!
দূরে রাখি গাভী-দলে,
রাখাল আমার তলে
বিরাম লভয়ে অনুক্ষণ,-
শুন, ধনি, রাজ-কাজ দরিদ্র পালন!
আমার প্রসাদ ভুঞ্জে পথ-গামী জন।
কেহ অন্ন রাঁধি খায়কেহ পড়ি নিদ্রা যায
এ রাজ চরণে।
মধু-মাখা ফল মোর বিখ্যাত ভূবনে!
তুমি কি তা জান না ললনে?
দেখ মোর ডাল-রাশি,
কত পাখি বাঁধে আসি
বাসা এ আগারে!
ধন্য মোর জনম সংসারে!
কিন্তু তব দুঃখ দেখি নিত্য আমি দুঃখী
নিন্দ বিধাতায় তুমি, নিন্দ, বিধুমুখী!
নীরবিলা তরুরাজ; উড়িল গগনে
যমদূতাকৃতি মেঘ গম্ভীর স্বননে;
মহাঘাতে মড়মড়ি
রসাল ভূতলে পড়ি
হায়, বায়ুবলে
হারাইল আয়ু-সহ দর্প বনস্থলে!
ঊর্ধ্বশির যদি তুমি কুল মান ধনে;
করিও না ঘৃণা তবু নিচ-শির জনে।


ষোলা আনাই মিছে ছড়া – সুকুমার রায়


ষোলা আনাই মিছে
সুকুমার রায়


বিদ্যে বোঝাই বাবুমশাই চড়ি সখের বোটে,
মাঝিরে কন, ''বলতে পারিস সূর্যি কেন ওঠে?
চাঁদটা কেন বাড়ে কমে? জোয়ার কেন আসে?''
বৃদ্ধ মাঝি অবাক হয়ে ফ্যাল্‌ফেলিয়ে হাসে।
বাবু বলেন, ''সারা জীবন মরলিরে তুই খাটি,
জ্ঞান বিনা তোর জীবনটা যে চারি আনাই মাটি।''

খানিক বাদে কহেন বাবু, ''বলতো দেখি ভেবে
নদীর ধারা কেমনে আসে পাহাড় থেকে নেবে?
বলতো কেন লবণপোরা সাগর ভরা পানি?''
মাঝি সে কয়, ''আরে মশাই অত কি আর জানি?''
বাবু বলেন, ''এই বয়সে জানিসনেও তা কি
জীবনটা তোর নেহাৎ খেলো, অষ্ট আনাই ফাঁকি!''

আবার ভেবে কহেন বাবু, '' বলতো ওরে বুড়ো,
কেন এমন নীল দেখা যায় আকাশের ঐ চুড়ো?
বলতো দেখি সূর্য চাঁদে গ্রহণ লাগে কেন?''
বৃদ্ধ বলে, ''আমায় কেন লজ্জা দেছেন হেন?''
বাবু বলেন, ''বলব কি আর বলব তোরে কি তা,-
দেখছি এখন জীবনটা তোর বারো আনাই বৃথা।''

খানিক বাদে ঝড় উঠেছে, ঢেউ উঠেছে ফুলে,
বাবু দেখেন, নৌকাখানি ডুবলো বুঝি দুলে!
মাঝিরে কন, '' একি আপদ! ওরে ও ভাই মাঝি,
ডুবলো নাকি নৌকা এবার? মরব নাকি আজি?''
মাঝি শুধায়, ''সাঁতার জানো?''- মাথা নাড়েন বাবু
মূর্খ মাঝি বলে, ''মশাই, এখন কেন কাবু?
বাঁচলে শেষে আমার কথা হিসেব করো পিছে,
তোমার দেখি জীবন খানা ষোল আনাই মিছে!''


বিষম চিন্তা ছড়া – সুকুমার রায়


বিষম চিন্তা
সুকুমার রায়


মাথায় কত প্রশ্ন আসে, দিচ্ছে না কেউ জবাব তার
সবাই বলে, ''মিথ্যে বাজে বকিসনে আর খবরদার!''
অমন ধারা ধমক দিলে কেমন করে শিখব সব?
বলবে সবাই ''মুখ্য ছেলে'', বলবে আমায় ''গো গর্দভ!''
কেউ কি জানে দিনের বেলায় কোথায় পালায় ঘুমের ঘোর?
বর্ষা হলেই ব্যাঙের গলায় কোত্থেকে হয় এমন জোর?
গাধার কেন শিং থাকে না, হাতির কেন পালক নেই?
গরম তেলে ফোড়ন দিলে লাফায় কেন তা ধেই ধেই?
সোডার বোতল খুললে কেন ফসফসিয়ে রাগ করে?
কেমন করে রাখবে টিকি মাথার যাদের টাক পড়ে?
ভূত যদি না থাকবে তবে কোত্থেকে হয় ভূতের ভয়?
মাথায় যাদের গোল বেঁধেছে তাদের কেন ''পাগোল'' কয়?
কতই ভাবি এসব কথার জবাব দেবার মানুষ কই?
বয়স হলে কেতাব খুলে জানতে পাব সমস্তই।


বাবুরাম সাপুড়ে ছড়া – সুকুমার রায়


বাবুরাম সাপুড়ে
সুকুমার রায়


বাবুরাম সাপুড়ে,
কোথা যাস বাপুরে
আয় বাবা দেখে যা,
দুটো সাপ রেখে যা -
যে সাপের চোখ নেই,
শিং নেই, নোখ নেই,
ছোটে না কি হাঁটে না,
কাউকে যে কাটে না,
করে না কো ফোঁসফাঁস
মারে নাকো ঢুসঢাস,
নেই কোন উৎপাত,
খায় শুধু দুধভাত,
সেই সাপ জ্যান্ত,
গোটা দুই আন তো,
তেড়ে মেরে ডাণ্ডা
ক'রে দিই ঠাণ্ডা।


ছিন্নমুকুল কবিতা – সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত


ছিন্নমুকুল
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত


সবচেয়ে যে ছোট্ট পিঁড়িখানি
সেইখানি আর কেউ রাখে না পেতে
ছোট থালায় হয় নাকো ভাত বাড়া
জল ভরে না ছোট্ট গেলাসেতে;
বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে যে ছোট
খাবার বেলায় কেউ ডাকে না তাকে,
সবচেয়ে যে শেষে এসেছিল
তারি খাওয়া ঘুচেছে সব-আগে।
সবচেয়ে যে অল্পে ছিল খুশি
খুশি ছিল ঘেঁষাঘেঁষির ঘরে,
সেই গেছে, হায়, হাওয়ার সঙ্গে মিশে,
দিয়ে গেছে জায়গা খালি করে।
ছেড়ে গেছে পুতুল, পুঁতির মালা,
ছেড়ে গেছে মায়ের কোলের দাবি;
ভয়-তরাসে ছিলো যে সবচেয়ে
সেই খুলেছে আঁধার ঘরের চাবি।

চলে গেছে একলা চুপে চুপে-
দিনের আলো গেছে আঁধার ক'রে;
যাবার বেলা টের পেলো না কেহ,
পারলে না কেউ রাখতে তারে ধ'রে।
চলে গেলো, - পড়তে চোখের পাতা,-
বিসর্জনের বাজনা শুনে বুঝি!
হারিয়ে গোলো- অজানাদের ভিড়ে,
হারিয়ে গেলো - পেলাম না আর খুঁজি।
হারিয়ে গেছে- হারিয়ে গেছে, ওরে!
হারিয়ে গেছে বোল-বলা সেই বাঁশি
হারিয়ে গেছে কচি সে মুখখানি,
দুধে-ধোওয়া কচি দাঁতের হাসি।।

আঁচল খুলে হঠাৎ স্রোতের জলে
ভেসে গেছে শিউলি ফুলের রাশি,
ঢুকেছে হায় শ্মশানঘরের মাঝে
ঘর ছেড়ে তাই হৃদয় শ্মশান-বাসী

।সব-চেয়ে যে ছোট কাপড়গুলি
সেগুলি কেউ দেয় না মেলে ছাদে,
যে শয্যাটি সবার চেয়ে ছোট
আজকে সেটি শূন্যে পড়ে কাঁদে,
সব-চেয়ে যে শেষে এসেছিলো
সে গিয়েছে সবার আগে সরে
ছোট্ট যে জন ছিলো রে সব চেয়ে
সে দিয়েছে সকল শূন্য করে।


পাল্কীর গান ছড়া – সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত


পাল্কীর গান
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত


পাল্কী চলে!
পাল্কী চলে!
গগন-তলে
আগুন জ্বলে!
স্তব্ধ গাঁয়ে
আদুল গায়ে
যাচ্ছে কারা
রৌদ্রে সারা
ময়রামুদি
চক্ষু মুদি'
পাটায় ব'সে
ঢুলছে ক'ষে।

দুধের চাঁছিশু
ষছে মাছি,
উড়ছে কতক
ভনভনিয়ে।
আসছে কা'রা
হন্ হনিয়ে?
হাটের শেষে
রুক্ষ বেশে
ঠিক দু'পুরে
ধায় হাটুরে!
কুকুর গুলো
শুঁকছে ধূলো,
ধুঁকছে কেহ
ক্লান্ত দেহ।

গঙ্গা ফড়িং
লাফিয়ে চলে;
বাঁধের দিকে
সূর্য্য ঢলে।

পাল্কী চলে রে,
অঙ্গ টলেরে!
আর দেরি কত?
আর কত দূর?


খাঁটি সোনা ছড়া – সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত


খাঁটি সোনা
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত


মধুর চেয়ে আছে মধুরর
সে এই আমার দেশের মাটি
আমার দেশের পথের ধূলা
খাঁটি সোনার চাইতে খাঁটি।

চন্দনেরি গন্ধভরা,
শীতল করা, ক্লান্তি-
হরাযেখানে তার অঙ্গ রাখি
সেখানটিতেই শীতল পাটি।

শিয়রে তার সূর্য এসে
সোনার কাঠি ছোঁয়ায় হেসে,
নিদ-মহলে জ্যোৎস্না নিতি
বুলায় পায়ে রূপার কাঠি।

নাগের বাঘের পাহারাতে
হচ্ছে বদল দিনে রাতে,
পাহাড় তারে আড়াল করে
সাগর সে তার ধোয়ায় পাটি।

নারিকেলের গোপন কোষে
অন্ন-পানী' যোগায় গো সে,
কোল ভরা তার কনক ধানে
আটটি শীষে বাঁধা আঁটি।
মধুর চেয়ে আছে মধুর
সে এই আমার দেশের মাটি।


বুঝিবে সে কিসে ছড়া – কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার


বুঝিবে সে কিসে
কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার


চিরসুখীজন ভ্রমে কি কখন
ব্যথিতবেদন বুঝিতে পারে?
কী যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে
কভু আশীবিষে দংশেনি যারে?
যতদিন ভবে, না হবে না হবে,
তোমার অবস্থা আমার সম।
ঈষৎ হাসিবে, শুনে না শুনিবে
বুঝে না বুঝিবে, যাতনা মম।


স্বর্গ ও নরক ছড়া – শেখ ফজলুল করিম


স্বর্গ ও নরক
শেখ ফজলুল করিম


কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর?
মানুষেরি মাঝে স্বর্গ নরক, মানুষেতে সুরাসুর!
রিপুর তাড়নে যখনই মোদের বিবেক পায় গো লয়,
আত্মগ্লানির নরক-অনলে তখনি পুড়িতে হয়।
প্রীতি ও প্রেমের পূণ্য বাঁধনে যবে মিলি পরষ্পরে,
স্বর্গ আসিয়া দাঁড়ায় তখন আমাদেরি কুঁড়ে ঘরে।


তুলনা কবিতা – শেখ ফজলুল করিম


তুলনা
শেখ ফজলুল করিম


সাত শত ক্রোশ করিয়া ভ্রমণ জ্ঞানীর অন্বেষণে,
সহসা একদা পেল সে প্রবীণ কোনো এক মহাজনে।
শুধাল, ''হে জ্ঞানী! আকাশের চেয়ে উচ্চতা বেশি কার?''
জ্ঞানী বলে, ''বাছা, সত্যের চেয়ে উঁচু নাহি কিছু আর।''
পুনঃ সে কহিল, ''পৃথিবীর চেয়ে ওজনে ভারী কি আছে?''
জ্ঞানী বলে, ''বাছা, নিষ্পাপ জনে দোষারোপ করা মিছে।''
জিজ্ঞাসে পুনঃ, ''পাথরের চেয়ে কি আছে অধিক শক্ত?''
জ্ঞানী বলে, ''বাছা, সেই যে হৃদয় জগদীশ-প্রেম-ভক্ত।''
কহিল আবার, ''অনলের চেয়ে উত্তাপ বেশি কার?''
জ্ঞানী বলে, ''বাছা, ঈর্ষার কাছে বহ্নিতাপও ছার।''
পুছিল পথিক, ''বরফের চেয়ে শীতল কি কিছু নাই?''
জ্ঞানী বলে, ''বাছা স্বজন-বিমুখ হৃদয় যে ঠিক তাই।''
শুধাল সে জন, ''সাগর হইতে কে বেশি ধনবান?''
জ্ঞানী বলে, ''বাছা, তুষ্ট হৃদয় তারো চেয়ে গরীয়ান।''


উত্তর কবিতা – শামসুর রাহমান


উত্তর
শামসুর রাহমান


তুমি হে সুন্দরীতমা নীলিমার দিকে তাকিয়ে বলতেই পারো
‘এই আকাশ আমার’
কিন্তু নীল আকাশ কোনো উত্তর দেবেনা।

সন্ধ্যেবেলা ক্যামেলিয়া হাতে নিয়ে বলতেই পারো,
‘ফুল তুই আমার’
তবু ফুল থাকবে নীরব নিজের সৌরভে আচ্ছন্ন হয়ে।

জ্যোত্স্না লুটিয়ে পড়লে তোমার ঘরে,
তোমার বলার অধিকার আছে, ‘এ জ্যোত্স্না আমার’
কিন্তু চাঁদিনী থাকবে নিরুত্তর।

মানুষ আমি, আমার চোখে চোখ রেখে
যদি বলো, ‘তুমি একান্ত আমার’, কী করে থাকবো নির্বাক ?
তারায় তারায় রটিয়ে দেবো, ‘আমি তোমার, তুমি আমার’।


আকাশে অনেক মুখ কবিতা – শামসুর রাহমান


আকাশে অনেক মুখ
শামসুর রাহমান


এ কেমন সন্ধ্যা ঘিরে ধরেছে আমার
প্রিয় এই শহরকে আজ। চতুর্দিকে
গুঁড়িয়ে পড়ছে ঘরবাড়ি। নরনারী, শিশুদের
বুকফাটা কান্নায় কাঁপছে পথঘাট, গাছপালা।

এই তো নিজেকে আমি ইট, পাথরের
স্তূপ থেকে আহত শরীর তুলে দেখি আশেপাশে,
সবদিকে অগণিত লাশ, কোনও কোনও
স্থানে ভাঙা পুতুল-জড়ানো হাতে নিষ্প্রাণ বালিকা।

আমাদের ছোট ঘরবাড়ি খুঁজে খুঁজে
আখেরে অধিকতর ক্লান্ত শরীরে অজানা
জায়গায় ভগ্নস্তূপে বসে পড়ি। হঠাৎ সমুখে
একটি ধূসর খাতা দেখে দ্রুত হাতে তুলে দিই।

আবিষ্কৃত খাতার প্রথম দুটি পাতা
গায়েব হলেও অবশিষ্ট বেশ কটি পাতা জুড়ে
রয়েছে কবিতা, সত্যি বলতে কী, কতিপয় পদ্য
পড়তেই উদ্ভাসিত প্রকৃত কবির পরিচয়।

কখন যে রাত ওর কোমল শরীর
নিয়ে সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ে, অদূরে গাছের
পাতাময় ডাল থেকে পাখির নিঝুম গান ঝরে
জ্যোৎস্নার ধরনে। ভেসে ওঠে আকাশে অনেক মুখ।


বারবার ফিরে আসে কবিতা – শামসুর রাহমান


বারবার ফিরে আসে
শামসুর রাহমান


বার বার ফিরে আসে রক্তাপ্লুত শার্ট
ময়দানে ফিরে আসে, ব্যাপক নিসর্গে ফিরে আসে,
ফিরে আসে থমথমে শহরের প্রকাণ্ড চোয়ালে।
হাওয়ায় হাওয়ায় ওড়ে, ঘোরে হাতে হাতে,
মিছিলে পতাকা হয় বারবার রক্তাপ্লুত শার্ট।
বিষম দামাল দিনগুলি ফিরে আসে বারবার,
বারবার কল্লোলিত আমাদের শহর ও গ্রাম।

‘আবার আসবো ফিরে’ ব’লে সজীব কিশোর
শার্টের আস্তিন দ্রুত গোটাতে গোটাতে
শ্লোগানের নিভাঁজ উল্লাসে
বারবার মিশে যায় নতুন মিছিলে, ফেরে না যে আর।
একটি মায়ের চোখ থেকে
করুণ প্লাবন মুছে যেতে না যেতেই
আরেক মায়ের চোখ শ্রাবণের অঝোরে আকাশ হ’য়ে যায়।
একটি বধূর
সংসার উজাড়-করা হাহাকার থামতে না থামতেই, হায়,
আরেক বধূর বুক খাঁ-খাঁ গোরস্থান হ’য়ে যায়,
একটি পিতার হাত থেকে কবরের কাঁচা মাটি
ঝ’রে পড়তে না পড়তেই
আরেক পিতার বুক-শূন্য-করা গুলিবিদ্ধ সন্তানের লাশ
নেমে যায় নীরন্ধ্র কবরে।


যদি তুমি ফিরে না আসো কবিতা – শামসুর রাহমান


যদি তুমি ফিরে না আসো
শামসুর রাহমান


তুমি আমাকে ভুলে যাবে, আমি ভাবতেই পারি না।
আমাকে মন থেকে মুছে ফেলে
তুমি
আছো এই সংসারে, হাঁটছো বারান্দায়, মুখ দেখছো
আয়নায়, আঙুলে জড়াচ্ছো চুল, দেখছো
তোমার সিঁথি দিয়ে বেরিয়ে গেছে অন্তুহীন উদ্যানের পথ, দেখছো
তোমার হাতের তালুতে ঝলমল করছে রূপালি শহর,
আমাকে মন থেকে মুছে ফেলে
তুমি অস্তিত্বের ভূভাগে ফোটাচ্ছো ফুল
আমি ভাবতেই পারি না।

যখনই ভাবি, হঠাৎ কোনো একদিন তুমি
আমাকে ভুলে যেতে পারো,
যেমন ভুলে গেছো অনেকদিন আগে পড়া
কোনো উপন্যাস, তখন ভয়
কালো কামিজ প’রে হাজির হয় আমার সামনে,
পায়চারি করে ঘন ঘন মগজের মেঝেতে,
তখন
একটা বুনো ঘোড়া খুরের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে আমাকে,
আর আমার আর্তনাদ ঘুরপাক খেতে খেতে
অবসন্ন হয়ে নিশ্চুপ এক সময়, যেমন
ভ্রষ্ট পথিকের চিৎকার হারিয়ে যায় বিশাল মরুভূমিতে।

বিদায় বেলায় সাঝটাঝ আমি মানি না
আমি চাই ফিরে এসো তুমি
স্মৃতি বিস্মৃতির প্রান্তর পেরিয়ে
শাড়ীর ঢেউ তুলে,সব অশ্লীল চিৎকার
সব বর্বর বচসা স্তব্দ করে
ফিরে এসো তুমি, ফিরে এসো
স্বপ্নের মতো চিলেকোঠায়
মিশে যাও স্পন্দনে আমার।


অভিশাপ দিচ্ছি কবিতা – শামসুর রাহমান


অভিশাপ দিচ্ছি
শামসুর রাহমান


আজ এখানে দাড়িয়ে এই রক্ত গোধূলিতে
অভিশাপ দিচ্ছি।
আমাদের বুকের ভেতর যারা ভয়ানক কৃষ্ঞপক্ষ
দিয়েছিলো সেঁটে,
মগজের কোষে কোষে যারা
পুতেছিলো আমাদেরই আপনজনের লাশ
দগ্ধ, রক্তাপ্লুত,
যারা গনহত্যা
করেছে শহরে গ্রামে টিলায় নদীতে ক্ষেত ও খামারে
আমি অভিশাপ দিচ্ছি নেকড়ের চেয়েও অধিক
পশু সেই সব পশুদের।
ফায়ারিং স্কোয়াডে ওদের
সারিবদ্ধ দাঁড়
করিয়ে নিমিষে ঝা ঝা বুলেটের বৃষ্টি
ঝরালেই সব চুকে বুকে যাবে তা আমি মানি না।
হত্যাকে উতসব ভেবে যারা পার্কে মাঠে
ক্যাম্পাসে বাজারে
বিষাক্ত গ্যাসের মতো মৃত্যুর বীভতস গন্ধ দিয়েছে ছড়িয়ে,
আমি তো তাদের জন্য অমন সহজ মৃত্যু করি না কামনা।
আমাকে করেছে বাধ্য যারা
আমার জনক জননীর রক্তে পা ডুবিয়ে দ্রুত
সিড়ি ভেন্গে যেতে আসতে
নদীতে আর বনবাদাড়ে শয্যা পেতে নিতে
অভিশাপ দিচ্ছি আজ সেইখানে দজ্জালদের।


ট্রেন কবিতা – শামসুর রাহমান


ট্রেন
শামসুর রাহমান


ঝক ঝক ঝক ট্রেন চলেছে
রাত দুপুরে অই।
ট্রেন চলেছে, ট্রেন চলেছে
ট্রেনের বাড়ি কই ?

একটু জিরোয়, ফের ছুটে যায়
মাঠ পেরুলেই বন।
পুলের ওপর বাজনা বাজে
ঝন ঝনাঝন ঝন।

দেশ-বিদেশে বেড়ায় ঘুরে
নেইকো ঘোরার শেষ।
ইচ্ছে হলেই বাজায় বাঁশি,
দিন কেটে যায় বেশ।

থামবে হঠাৎ মজার গাড়ি
একটু কেশে খক।
আমায় নিয়ে ছুটবে আবার
ঝক ঝকাঝক ঝক।


একটি কবিতার জন্য কবিতা – শামসুর রাহমান


একটি কবিতার জন্য
শামসুর রাহমান


বৃক্ষের নিকটে গিয়ে বলি ;
দয়াবান বৃক্ষ তুমি একটি কবিতা দিতে পারো ?
বৃক্ষ বলে আমার বাকল ফুঁড়ে আমার মজ্জায়
যদি মিশে যেতে পারো, তবে
হয়তো বা পেয়ে যাবে একটি কবিতা !

জীর্ণ দেয়ালের কানে বলি ;
দেয়াল আমাকে তুমি একটি কবিতা দিতে পারো ?
পুরোনো দেয়াল বলে শ্যাওলা-ঢাকা স্বরে,
এই ইঁট সুরকির ভেতর যদি নিজেকে গুঁড়িয়ে দাও, তবে
হয়তো বা পেয়ে যাবে একটি কবিতা !

একজন বৃদেধের নিকট গিয়ে বলি, নতজানু,
হে প্রাচীন দয়া ক'রে দেবেন কি একটি কবিতা ?
স্তব্ ধতার পর্দা ছিঁড়ে বেজে ওঠে প্রাজ্ঞ কণ্ঠে - যদি
আমার মুখের রেখাবলী
তুলে নিতে পারো
নিজের মুখাবয়বে, তবে
হয়তো বা পেয়ে যাবে একটি কবিতা।

কেবল কয়েক ছত্র কবিতার জন্যে
এই বৃক্ষ, জরাজীর্ণ দেয়াল এবং
বৃদ্ধের সম্মুখে নতজানু আমি থাকবো কতোকাল ?
বলো কতোকাল ?


আমার মৃত্যুর পরেও যদি কবিতা – শামসুর রাহমান


আমার মৃত্যুর পরেও যদি
শামসুর রাহমান


একটি পাখী রোজ আমার জানালায়
আস্তে এসে বসে, তাকায় আশেপাশে।
কখনো দেয় শিস, বাড়ায় গলা তার;
আবার কখনোবা পাখাটা ঝাপটায়।

পালকে তার আঁকা কিসের ছবি যেন,
দু’চোখে আছে জমা মেঘের স্মৃতি কিছু;
নদীর স্বপ্নের জলজ কণাগুলি
এখনো তাঁর ঠোটে হয়তো গচ্ছিত।

কাউকে নীড়ে তার এসেছে ফেলে বুঝি?
হয়তো সেই নীড়, আকাশই আস্তানা।
তাই তো চোখ তার এমন গাঢ় নীল,
মেললে পাখা জাগে নীলের উৎসব।

যখন লিখি আমি টেবিলে ঝুঁকে আর
পড়তে বসি বই, তখন সেই পাখি
চকিতে দোল খায় আমার জানালায়-
খাতার পাতা জুড়ে ছড়িয়ে দেয় খুশি।

আমার মৃত্যুর পরেও যদি সেই
সুনীল পাখি আসে আমার জানালায়,
আবার শিস দেয়, আমার বইখাতা
যদি সে ঠোকরায়, দিও না বাধা তাকে।

পণ্ডশ্রম কবিতা – শামসুর রাহমান


পণ্ডশ্রম
শামসুর রাহমান


এই নিয়েছে ঐ নিল যাঃ! কান নিয়েছে চিলে,
চিলের পিছে মরছি ঘুরে আমরা সবাই মিলে।
কানের খোঁজে ছুটছি মাঠে, কাটছি সাঁতারবিলে,
আকাশ থেকে চিলটাকে আজ ফেলব পেড়ে ঢিলে।
দিন-দুপুরে জ্যান্ত আহা, কানটা গেল উড়ে,
কান না পেলে চার দেয়ালে মরব মাথা খুঁড়ে।
কান গেলে আর মুখের পাড়ায় থাকল কি-হে বল?
কানের শোকে আজকে সবাই মিটিং করি চল।
যাচ্ছে, গেল সবই গেল, জাত মেরেছে চিলে,
পাঁজি চিলের ভূত ছাড়াব লাথি-জুতো কিলে।
সুধী সমাজ! শুনুন বলি, এই রেখেছি বাজি,
যে-জন সাধের কান নিয়েছে জান নেব তার আজই।
মিটিং হল ফিটিং হল, কান মেলে না তবু,
ডানে-বাঁয়ে ছুটে বেড়াই মেলান যদি প্রভু!
ছুটতে দেখে ছোট ছেলে বলল, কেন মিছে
কানের খোঁজে মরছ ঘুরে সোনার চিলের পিছে?
নেইকো খালে, নেইকো বিলে, নেইকো মাঠে গাছে;
কান যেখানে ছিল আগে সেখানটাতেই আছে।
ঠিক বলেছে, চিল তবে কি নয়কো কানের যম?
বৃথাই মাথার ঘাম ফেলেছি, পণ্ড হল শ্রম।


একটি ফটোগ্রাফ কবিতা – শামসুর রাহমান


একটি ফটোগ্রাফ
শামসুর রাহমান


এই যে আসুন, তারপর কী খবর?
আছেন তো ভাল? ছেলেমেয়ে?’ কিছু আলাপের পর
দেখিয়ে সফেদ দেয়ালের শান্ত ফটোগ্রাফটিকে
বললাম জিজ্ঞাসু অতিথিকে–
‘এই যে আমার ছোট ছেলে, যে নেই এখন,
পাথরের টুকরোর মতন
ডুবে গেছে আমাদের গ্রামের পুকুরে
বছর-তিনেক আগে কাক-ডাকা গ্রীষ্মের দুপুরে।’
কী সহজে হয়ে গেল বলা,
কাঁপলো না গলা
এতটুকু, বুক চিরে বেরুলো না দীর্ঘশ্বাস, চোখ ছলছল
করলো না এবং নিজের কন্ঠস্বর শুনে
নিজেই চমকে উঠি, কি নিস্পৃহ, কেমন শীতল।
তিনটি বছর মাত্র তিনটি বছর
কত উর্ণাজাল বুনে
কেটেছে, অথচ এরই মধ্যে বাজখাঁই
কেউ যেন আমার শোকের নদীটিকে কত দ্রুত রুক্ষ চর
করে দিলো। অতিথি বিদায় নিলে আবার দাঁড়াই
এসে ফটোগ্রাফটির প্রশ্নাকুল চোখে,
ক্ষীয়মান শোকে।
ফ্রেমের ভেতর থেকে আমার সন্তান
চেয়ে থাকে নিষ্পলক,তার চোখে নেই রাগ কিংবা অভিমান।


একটি পাখি কবিতা – শামসুর রাহমান


একটি পাখি
শামসুর রাহমান


বহু দূরের পথ পেরিয়ে, বন পেরিয়ে
এই শহরে আসবে উড়ে
একটি পাখি ভাল।
তার দু চোখে মায়াপুরীর ছায়া আছে,
দূর পাতালের স্বপ্ন আছে
আছে তারার আলো।

সেই পাখিটা এই শহরে আসবে বলে
পথে ধারে ভিড় জমেছে,
সবাই তাকায় দূরে।
চোখগুলো সব আকাশ পারে বেড়ায় সেই-
মস্ত রঙিন পাখা নেড়ে
আসবে পাখি উড়ে।

রাঙা ঠোঁটের সেই পাখিটা ঝড়ে-কাঁপা
আকাশ ছেড়ে নামবে পথে,
সবাই নেবে পিছু।
সেই পাখিটা স্বর্গপথের নানান গানে
শহরটাকে করবে মধুর,
বলবে খবর কিছু।

কিন্তু কোথায় সেই পাখিটা? এই শহরে
বাজল না তার পাখা দুটি।
আকাশ করে ধু-ধু।
শহরবাসী ক্লান্ত হয়ে ফিরল ঘরে,
সবাই ঘুমে সেই পাখিটার
স্বপ্ন দেখে শুধু।


রৌদ্র লেখে জয় কবিতা – শামসুর রাহমান


রৌদ্র লেখে জয়
শামসুর রাহমান


বর্গি এলো খাজনা নিতে,
মারল মানুষ কত।
পুড়ল শহর, পুড়ল শ্যামল
গ্রাম যে শত শত।

হানাদারের সঙ্গে জোরে
লড়ে মুক্তিসেনা,
তাদের কথা দেশের মানুষ
কখনো ভুলবে না।

আবার দেখি নীল আকাশে
পায়রা মেলে পাখা,
মা হয়ে যায় দেশের মাটি,
তার বুকেতেই থাকা।।

কাল যেখানে আঁধার ছিল
আজ সেখানে আলো।
কাল যেখানে মন্দ ছিল,
আজ সেখানে ভালো।

কাল যেখানে পরাজয়ের
কালো সন্ধ্যা হয়,
আজ সেখানে নতুন করে
রৌদ্র লেখে জয়।


প্রিয় স্বাধীনতা কবিতা – শামসুর রাহমান


প্রিয় স্বাধীনতা
শামসুর রাহমান


মেঘনা নদী দেব পাড়ি
কল-অলা এক নায়ে।
আবার আমি যাব আমার
পাহাড়তলী গাঁয়ে।

গাছ-ঘেরা ঐ পুকুরপাড়ে
বসব বিকাল বেলা।
দু-চোখ ভরে দেখব কত
আলো-ছায়ার খেলা।

বাঁশবাগানে আধখানা চাঁদ
থাকবে ঝুলে একা।
ঝোপে ঝাড়ে বাতির মতো
জোনাক যাবে দেখা।

ধানের গন্ধ আনবে ডেকে
আমার ছেলেবেলা।
বসবে আবার দুচোখ জুড়ে
প্রজাপতির মেলা।

হঠাৎ আমি চমকে উঠি
হলদে পাখির ডাকে।
ইচ্ছে করে ছুটে বেড়াই
মেঘনা নদীর বাঁকে।

শত যুগের ঘন আঁধার
গাঁয়ে আজো আছে।
সেই আঁধারে মানুষগুলো
লড়ায় করে বাঁচে।

মনে আমার ঝলসে ওঠে
একাত্তরের কথা,
পাখির ডানায় লিখেছিলাম-
প্রিয় স্বাধীনতা।


সাইক্লোন কবিতা – শামসুর রাহমান


সাইক্লোন
শামসুর রাহমান


চাল উড়ছে, ডাল উড়ছে
উড়ছে গরু, উড়ছে মোষ।
খই উড়ছে, বই উড়ছে
উড়ছে পাঁজি, বিশ্বকোষ।

ময়লা চাদর, ফরসা জামা,
উড়ছে খেতের শর্ষে, যব।
লক্ষ্মীপ্যাঁচা, পক্ষীছানা
ঘুরছে, যেন চরকি সব।

মাছ উড়ছে, গাছ উড়ছে
ঘুর্ণি হাওয়া ঘুরছে জোর।
খাল ফুলছে, পাল ছিঁড়ছে
রুখবে কারা পানির তোড়?

হারান মাঝি, পরান শেখ
বাতাস ফুঁড়ে দিচ্ছে ডাক।
আকাশ ভেঙে কাঁচের গুঁড়ো
উঠল আজান, বাজল শাখ।

চম্পাবতীর কেশ ভাসছে
ভাসছে স্রোতে খড়ের ঘর।
শেয়াল কুকুর কুঁকড়ো শালিক
ডুবল সবই, ডুবলো চর।


তুমি বলেছিলে কবিতা – শামসুর রাহমান


তুমি বলেছিলে
শামসুর রাহমান


দাউ দাউ পুড়ে যাচ্ছে নতুন বাজার।
পুড়ছে দোকান-পাট, কাঠ,
লোহা-লক্কড়ের স্তূপ, মসজিদ এবং মন্দির।
দাউ দাউ পুড়ে যাচ্ছে নতুন বাজার।

বিষম পুড়ছে চতুর্দিকে ঘর-বাড়ি।
পুড়ছে টিয়ের খাঁচা, রবীন্দ্র রচনাবলি, মিষ্টান্ন ভাণ্ডার,
মানচিত্র, পুরনো দলিল।
মৌচাকে আগুন দিলে যেমন সশব্দে
সাধের আশ্রয় ত্যাগী হয়
মৌমাছির ঝাঁক,
তেমনি সবাই
পালাচ্ছে শহর ছেড়ে দিগ্বিদিক। নবজাতককে
বুকে নিয়ে উদ্ভ্রান্ত জননী
বনপোড়া হরিণীর মত যাচ্ছে ছুটে।
অদূরে গুলির শব্দ, রাস্তা চষে জঙ্গী জীপ। আর্ত
শব্দ সবখানে। আমাদের দু'জনের
মুখে খরতাপ। আলিঙ্গনে থরো থরো
তুমি বলেছিলে,
‌'আমাকে বাঁচাও এই বর্বর আগুন থেকে, আমাকে বাঁচাও,
আমাকে লুকিয়ে ফেলো চোখের পাতায়
বুকের অতলে কিংবা একান্ত পাঁজরে
আমাকে নিমেষে শুষে নাও
চুম্বনে চুম্বনে।'

দাউ দাউ পুড়ে যাচ্ছে নতুন বাজার,
আমাদের চৌদিকে আগুন,
গুলির ইস্পাতী শিলাবৃষ্টি অবিরাম।
তুমি বলেছিলে
আমাকে বাঁচাও।
অসহায় আমি তাও বলতে পারিনি।


আসাদের শার্ট কবিতা – শামসুর রাহমান


আসাদের শার্ট
শামসুর রাহমান


গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের
জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট
উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায়।

বোন তার ভায়ের অম্লান শার্টে দিয়েছে লাগিয়ে
নক্ষত্রের মতো কিছু বোতাম কখনো
হৃদয়ের সোনালী তন্তুর সূক্ষতায়
বর্ষীয়সী জননী সে-শার্ট
উঠোনের রৌদ্রে দিয়েছেন মেলে কতদিন স্নেহের বিন্যাসে।

ডালীম গাছের মৃদু ছায়া আর রোদ্দুর- শেভিত
মায়ের উঠোন ছেড়ে এখন সে-শার্ট
শহরের প্রধান সড়কে
কারখানার চিমনি-চূড়োয়
গমগমে এভেন্যুর আনাচে কানাচে
উড়ছে, উড়ছে অবিরাম
আমাদের হৃদয়ের রৌদ্র-ঝলসিত প্রতিধ্বনিময় মাঠে,
চৈতন্যের প্রতিটি মোর্চায়।

আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখন্ড বস্ত্র মানবিক ;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা।


তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা কবিতা – শামসুর রাহমান


তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা
শামসুর রাহমান


তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা,
তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায় ?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন ?

তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
সাকিনা বিবির কপাল ভাঙলো,
সিঁথির সিঁদুর গেল হরিদাসীর।
তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
শহরের বুকে জলপাইয়ের রঙের ট্যাঙ্ক এলো
দানবের মত চিৎকার করতে করতে
তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
ছাত্রাবাস বস্তি উজাড হলো। রিকয়েললেস রাইফেল
আর মেশিনগান খই ফোটালো যত্রতত্র।
তুমি আসবে ব’লে, ছাই হলো গ্রামের পর গ্রাম।
তুমি আসবে ব’লে, বিধ্বস্ত পাডায় প্রভূর বাস্তুভিটার
ভগ্নস্তূপে দাঁডিয়ে একটানা আর্তনাদ করলো একটা কুকুর।
তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
অবুঝ শিশু হামাগুডি দিলো পিতামাতার লাশের উপর।

তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা, তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায় ?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন ?
স্বাধীনতা, তোমার জন্যে এক থুত্থুরে বুডো
উদাস দাওয়ায় ব’সে আছেন – তাঁর চোখের নিচে অপরাহ্ণের
দুর্বল আলোর ঝিলিক, বাতাসে নডছে চুল।
স্বাধীনতা, তোমার জন্যে
মোল্লাবাডির এক বিধবা দাঁডিয়ে আছে
নডবডে খুঁটি ধ’রে দগ্ধ ঘরের।

স্বাধীনতা, তোমার জন্যে
হাড্ডিসার এক অনাথ কিশোরী শূন্য থালা হাতে
বসে আছে পথের ধারে।
তোমার জন্যে,
সগীর আলী, শাহবাজপুরের সেই জোয়ান কৃষক,
কেষ্ট দাস, জেলেপাডার সবচেয়ে সাহসী লোকটা,
মতলব মিয়া, মেঘনা নদীর দক্ষ মাঝি,
গাজী গাজী ব’লে নৌকা চালায় উদ্দান ঝডে
রুস্তম শেখ, ঢাকার রিকশাওয়ালা, যার ফুসফুস
এখন পোকার দখলে
আর রাইফেল কাঁধে বনে জঙ্গলে ঘুডে বেডানো
সেই তেজী তরুণ যার পদভারে
একটি নতুন পৃথিবীর জন্ম হ’তে চলেছে –
সবাই অধীর প্রতীক্ষা করছে তোমার জন্যে, হে স্বাধীনতা।

পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জ্বলন্ত
ঘোষণার ধ্বনিপ্রতিধ্বনি তুলে,
মতুন নিশান উডিয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক
এই বাংলায়
তোমাকেই আসতে হবে, হে স্বাধীনতা।


স্বাধীনতা তুমি কবিতা – শামসুর রাহমান


স্বাধীনতা তুমি
শামসুর রাহমান


স্বাধীনতা তুমি 
রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান। 
স্বাধীনতা তুমি 
কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো 
মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা- 
স্বাধীনতা তুমি 
শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সভা 
স্বাধীনতা তুমি 
পতাকা-শোভিত শ্লোগান-মুখর ঝাঁঝালো মিছিল। 
স্বাধীনতা তুমি 
ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি। 
স্বাধীনতা তুমি 
রোদেলা দুপুরে মধ্যপুকুরে গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতার। 
স্বাধীনতা তুমি 
মজুর যুবার রোদে ঝলসিত দক্ষ বাহুর গ্রন্থিল পেশী। 
স্বাধীনতা তুমি 
অন্ধকারের খাঁ খাঁ সীমান্তে মুক্তিসেনার চোখের ঝিলিক। 
স্বাধীনতা তুমি 
বটের ছায়ায় তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থীর 
শানিত কথার ঝলসানি-লাগা সতেজ ভাষণ। 
স্বাধীনতা তুমি 
চা-খানায় আর মাঠে-ময়দানে ঝোড়ো সংলাপ। 
স্বাধীনতা তুমি 
কালবোশেখীর দিগন্তজোড়া মত্ত ঝাপটা। 
স্বাধীনতা তুমি 
শ্রাবণে অকূল মেঘনার বুক 
স্বাধীনতা তুমি পিতার কোমল জায়নামাজের উদার জমিন। 
স্বাধীনতা তুমি 
উঠানে ছড়ানো মায়ের শুভ্র শাড়ির কাঁপন। 
স্বাধীনতা তুমি 
বোনের হাতের নম্র পাতায় মেহেদীর রঙ। 
স্বাধীনতা তুমি বন্ধুর হাতে তারার মতন জ্বলজ্বলে এক রাঙা পোস্টার। 
স্বাধীনতা তুমি 
গৃহিণীর ঘন খোলা কালো চুল, 
হাওয়ায় হাওয়ায় বুনো উদ্দাম। 
স্বাধীনতা তুমি 
খোকার গায়ের রঙিন কোর্তা, 
খুকীর অমন তুলতুলে গালে 
রৌদ্রের খেলা। 
স্বাধীনতা তুমি 
বাগানের ঘর, কোকিলের গান, 
বয়েসী বটের ঝিলিমিলি পাতা, 
যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা।


বন্দী শিবির থেকে কবিতা – শামসুর রাহমান


বন্দী শিবির থেকে
শামসুর রাহমান


ঈর্ষাতুর নই, তবু আমি
তোমাদের আজ বড় ঈর্ষা করি। তোমরা সুন্দর
জামা পরো, পার্কের বেঞ্চিতে বসে আলাপ জমাও,
কখনো সেজন্যে নয়। ভালো খাও দাও,
ফুর্তি করো সবান্ধব
সেজন্যেও নয়।

বন্ধুরা তোমরা যারা কবি,
স্বাধীন দেশের কবি, তাদের সৌভাগ্যে
আমি বড়ো ঈর্ষান্বিত আজ।
যখন যা খুশি
মনের মতো শব্দ কী সহজে করো ব্যবহার
তোমরা সবাই।
যখন যে শব্দ চাও, এসে গেলে সাজাও পয়ারে,
কখনো অমিত্রাক্ষরে, ক্ষিপ্র মাত্রাবৃত্তে কখনো-বা।
সেসব কবিতাবলী, যেন রাজহাঁস
দৃপ্ত ভঙ্গিমায় মানুষের
অত্যন্ত নিকটে যায়, কুড়ায় আদর।

অথচ এদেশে আমি আজ দমবদ্ধ
এ বন্দী-শিবিরে
মাথা খুঁড়ে মরলেও পারি না করতে উচ্চারণ
মনের মতন শব্দ কোনো।
মনের মতন সব কবিতা লেখার
অধিকার ওরা
করেছে হরণ।
প্রকাশ্য রাস্তায় যদি তারস্বরে চাঁদ, ফুল, পাখি
এমনকি নারী ইত্যাকার শব্দাবলী
করি উচ্চারণ, কেউ করবে না বারণ কখনো।
কিন্তু কিছু শব্দকে করেছে
বেআইনী ওরা
ভয়ানক বিস্ফোরক ভেবে।

স্বাধীনতা নামক শব্দটি
ভরাট গলায় দীপ্ত উচ্চারণ করে বারবার
তৃপ্তি পেতে চাই। শহরের আনাচে কানাচে
প্রতিটি রাস্তায়
অলিতে-গলিতে,
রঙিন সাইনবোর্ড, প্রত্যেক বাড়িতে
স্বাধীনতা নামক শব্দটি আমি লিখে দিতে চাই
বিশাল অক্ষরে।
স্বাধীনতা শব্দ এত প্রিয় যে আমার
কখনো জানিনি আগে। উঁচিয়ে বন্দুক,
স্বাধীনতা, বাংলাদেশ- এই মতো শব্দ থেকে ওরা
আমাকে বিচ্ছিন্ন করে রাখছে সর্বদা।

অথচ জানেনা ওরা কেউ
গাছের পাতায়, ফুটপাতে
পাখির পালকে কিংবা নারীর দু’চোখে
পথের ধুলায়
বস্তির দুরন্ত ছেলেটার
হাতের মুঠোয়
সর্বদাই দেখি জ্বলে স্বাধীনতা নামক শব্দটি।

[২১ জুলাই ১৯৭১ তারিখে কবিতাটি ভারতীয় ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ছদ্মনামে। মজলুম আদিব, যার অর্থ নির্যাতিত কবি]


সুধাংশু! এবার তুই পালা কবিতা – আলমগীর হুসেন


সুধাংশু! এবার তুই পালা
আলমগীর হুসেন


পাগলামী করিসনে বন্ধু সুধাংশু
সময় যে পার হয়ে যাচ্ছে
এবার যে তোর পালানোর বেলা
জিদ করিসনে বন্ধু, এখনই তুই পালা।

জানি তুই কী ভাবছিস বন্ধু সুধাংশু
দাঁড়িয়ে হাহাকারের ছোঁয়ায় জড়ানো শ্মশানসম বাস্তুভিটায়
সেই হারিয়ে যাওয়া প্রাণচঞ্চল দিনগুলো, আমাদের ছেলেবেলা
কিন্তু এবার যে তোর পালানোর বেলা, এবার তুই পালা।

আমি জানি নির্বাক দাঁড়িয়ে তুই কী ভাবছিস বন্ধু সুধাংশু
সেই একপাল বন্ধুগুলো ­ রামী, শেপু, কাকলী আরও অনেকে
প্রাণময় কোলাহলে কাটিয়েছি সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা বেলা
কিন্তু এবার যে তোকে পালাতে হবে, এবার তুই পালা।

আমি বুঝি তোর শঙ্কা আগামী বিরহ বেদনার বন্ধু সুধাংশু
আড়াই যুগ ধরে তিলে তিলে গড়ে উঠা আত্মার সম্পর্ক ­-
এই বাস্তুভিটার সাথে আর একঝাঁক বন্ধুর ভালবাসা প্রাণঢালা।
কিন্তু এবার যে তোকে পালাতে হবে, এবার তুই পালা।

কোথায় সেই কল-কাকলীতে মুখরিত সবুজ সুন্দর কাপালী-ভিটাটি বন্ধু সুধাংশু
দু’টি জীর্ণ-শীর্ণ ঘর চির-দুঃখীর মতো দাঁড়িয়ে আছে আজ সেই কাপালী ভিটায়।
কোথায় সেই রামী, শেপু, কাকলী আরও সেই প্রিয় বন্ধুগুলা
ওরা যে সবাই পালিয়েছে, এবার তোর পালা।

তুই কি জানিস বন্ধু সুধাংশু
তোর বিদায়ে ভীষণ ব্যথা পাবে আমার ঐ ছ’বছরের অবুঝ বোনটি ‘নেহা’
কাটাবে কত সন্ধ্যা অধীর প্রত্যাশায়, সুধাংশু ভাইকে জড়িয়ে ধরবেঃ কোথায় চকলেটগুলা?
তবুও তোকে পালাতে হবে যে, এবার তুই পালা।

আরও জানি বন্ধু সুধাংশু
তোর ষোড়শী বোনটি ‘মিলা’ দুষ্টামির ছলে আর বলতে পারবে নাঃ আলমদা তুমি এত কৃপণ কেন?
চলো মেলায় নিয়ে, কিনে দিতে হবে সুন্দর একটি মালা।
তথাপি তোকে পালাতে যে হবে, এবার তুই পালা।

তোকে যে বলা হয় নি বন্ধু সুধাংশু
মিলা’র সহপাঠী আমার ভাইটি ‘রিপন’ বলছিল সেদিনঃ ভাইয়া মিলা’টা যা সুন্দর হয়েছে না!
বলে দিয়েছি ওকে, সুন্দরী মেধাবী মিলা বিশ্ব জয় করবে, তোর মতো গর্দভটি ওর দিকে তাকাবে না।
তোর হাতে যে সময় নেই বন্ধু, এবার তুই পালা।

মিলাকে যে বিশ্ব জয় করতেই হবে বন্ধু সুধাংশু
অসাধারণ সুন্দরী মেধাবী মিলার জন্য এক ধর্ষিত, অচ্ছুৎ, অভাগী নারীর জীবন ­
হবে মানবতার জন্য এক অমার্জনীয় ব্যর্থতা।
তাই আমার কাতর মিনতি বন্ধু, এখনই তুই পালা।


রজনীগন্ধার উপমা কবিতা – আহমেদ ছফা


রজনীগন্ধার উপমা
আহমেদ ছফা


ইচ্ছে করে মাঝে মাঝে, জ্বলে উঠি
ফেটে পড়ি তীব্র বিস্ফোরণে
ভেঙ্গে ফেলি হাটে হাঁড়ি
জানুক নগরবাসী, শুনুক সকলে
তােমার চরিতকথা
মহিলা হে কি রকম তুমি!

রজনীগন্ধাকে আমি বড় বেশি
ভালবাসি, ব্যথা দিতে নিজে ব্যথা পাই
এতদিন বলি বলি করে তাই বলতে পারিনি;
এ আমার দুর্বলতা, কলঙ্কও বলতে পার
তােমাকে পুষ্পের সঙ্গে অভিন্ন দেখেছি।

অবিকল গন্ধবহ ফুল্লমুখি নারী
রজনীগন্ধার মত অভিমানে নিত্য নতমুখি

মুখোমুখি দেখা হলে বাক্য জমে যায়
কি এক বয়েসী বােধে হঠাৎ নিশ্চল হয়ে উঠি
তােমাকে ব্যথা দিলে
রজনীগন্ধার দল ব্যথা পাবে ভেবে।


জল্লাদের সময় কবিতা – আহমদ ছফা


জল্লাদের সময়
আহমদ ছফা


১.
আমাদের এ সময় সুসময় নয়
জোয়ারে হিন্দোল দোলা, ভাটায় মন্থর
চেনাজানা ভদ্র নদী ভেবে
যেজন ভাসাবে ডিঙ্গা পৈতৃক বিশ্বাসে
জেনে রাখ সর্বনাশ সম্মুখে তোমার।

২.
দেশটা যেন বদ্ধজলা
এদিকে মরণ ওদিকেও তেমন

৩.
আমি তো নিশ্চিত জানি
বাস করি ভিন্ন ভূ-মণ্ডলে
বন্দী আমি, মুক্ত আমি আপন সমাজে....
অসীম সাহসী আমি
লোহার লাঙল দিয়ে পাথরে মৃত্তিকা চাষ করি।

৪.
দলে দলে তারা বলে
যুদ্ধ হবে
আরো একবার যুদ্ধহবে
পালঙ্ক শায়িত লাশ এই বাঙলায়।


শুধু একটি শব্দের জন্য কবিতা – আহমদ ছফা


শুধু একটি শব্দের জন্য
আহমদ ছফা


তুমি যখন রজনীগন্ধার ডাঁটার মত নত হয়ে
ঘরের মধ্যে পা রাখলে সারাঘরে খেলে গেল একটা স্পন্দন
হঠাৎ যেন বদ্ধ হওয়া শিউরে উঠল।
তুমি যখন বাঁকাচোরা হাত দুটো আলতোভাবে
কোলের উপর শুইয়ে রাখলে
অপার বাঙময় সে দুটো অপরূপ হাত
বীণার মত বেজে উঠতে চাইল।
তুমি যখন শরীরের বসন টেনে টুনে ঠিক করায়
হঠাৎ খুব মনোযোগী হয়ে উঠলে, মনে হল
শরীর ঢাকতে গিয়ে তুমি শরীর থেকে পালাতে চাইছ।

অমনি তোমার ভেতর থেকে একটা স্নিগ্ধ
বিদ্যুৎপ্রবাহ নির্গত হয়ে আমাকে তড়িতাহত করল।
তুমি যখন কার্পেটে বুড়ো আঙুল খুঁটে খুঁটে মেঝের
পানে তাকিয়ে খুউব নিচুস্বরে কথা বললে
মনে হয় ঘরে দেয়ালগুলো সন্তর্পণে কান পেতে আছে
যাতে তোমার প্রতিটি উচ্চারিত ধ্বনি দেয়ালের মর্মে বিধে থাকে।

যখন আমি তোমার কাছে গেলাম, মনে হল
একটা নির্জন ঝর্ণার পাশে এসে দাঁড়িয়েছি
জাগতিকতার কোলাহল থেকে অনেক দূরে যার উৎসস্থল।
আর যে ঝর্ণা মৃদুস্বরে কেবল নিজের সঙ্গেই আলাপ করে।
আমি যখন তোমার ঘরের বাইরে পা রাখলাম
আমার রক্তে, আমার অনুভবে ফুটন্ত ঝর্ণার আবেগ;
একটা মৃদু মোহন প্রীতিবদ উত্তাপে আমার
ভেতরের পদার্থ সকল গলানো মোমের মত বেরিয়ে আসতে চাইছে।
যত দূরেই যাচ্ছি পথের পাশের সব কিছুর মধ্যে
যে ঝর্ণার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়নি,
সে অদৃশ্য ঝর্ণার ঝংকার শুনতে পাচ্ছি।

আমি গগনে মেঘ দেখামাত্র মেঘের অংশ
হয়ে গেলাম। বৃক্ষ দেখে বৃক্ষের আকার
ধারণ করলাম। যখন নদীর সান্নিধ্যে এলাম
ছলছল ধ্বনিতে বয়ে যাওয়ার আবেগ আমার
বুকের ভেতর তরঙ্গ সৃষ্টি করল। তারপরে
যখন আকাশের অভিমুখে দৃকপাত করলাম,
দেখলাম ঘুঙুর পরা নক্ষত্ররা একে একে
আমার প্রাণে এসে প্রাণের চেরাগ জ্বালিয়ে তুলছে।

তুমি আমাকে চরাচরে প্রবাহিত হওয়ার
আশ্চর্য ক্ষমতার অধিকারী করেছ।
তুমি আমার হাতে তুলে দিলে বিশ্বলোকে
বিহার করার টাটকা নতুন ছাড়পত্র।
হে নারী তোমাকে কি নামে ডাকব।
কোন নামে ডাকলে তোমার হৃৎকমল সুখসমীরে
আন্দোলিত হয়। কোন নামে ডাকলে আমার
নাভিপদ্মের মূল থেকে শৈলের
সোনালী পোনার মত যে অনুভবরাশি
ওপরে ভেসে উঠেছে তার বিশ্বস্ত প্রকাশ ঘটাতে পারি!


বেতারে খবর ঝরে কবিতা – আহমদ ছফা


বেতারে খবর ঝরে
আহমদ ছফা


বেতারে খবর ঝরে,
তাজা খুন; কাঁচা প্রাণ ঝরে
ভিয়েৎনামে; পথে পথে
নগরে বন্দরে, বনে বনান্তরে
রক্ত ঝরে, রক্ত ঝরে
তপ্ত রক্ত ঝরে।
জিঘাংসার জটা মুক্ত সাগ্নিক নিঃশ্বাসে মূর্ত
মমচেরা কামনার বেশুমার নিহত মুহূর্ত
অকস্মাৎ আগ্নেয় ঝলকে
দুর্মর চেতনারশ্মি  দুর্জয় প্রত্যয়ে ফুসে
তুলি লক্ষ গোখরার ফণা
দুরন্ত মাভৈঃ সুরে সবল দরাজ কণ্ঠে উদাত্ত ঘোষণা
মার্কিনির বর্বরতা ক্ষমা করিব না।
জন্মে জন্মে যুগে ক্ষমা করিব না
কোটি কণ্ঠে নৃশংস ঘোষণা।
আত্মারে গচ্ছিত রেখে পাপের হারেমে
জোব্বা পরা লম্পটেরা;
নারীর সতীত্ব লুটে বীরত্বের দর্প করে যারা
যারা দুনিয়ার লোভে সত্যসন্ধ মানুষের বেচাকেনা করে,
যাদের পাশব শৈর্যে মানবতা মাথা কুটে মরে,
যাদের নাপাং বোমা ফুলের ফাগুনভরা
সবুজ পোয়াতি ক্ষেতে আগুন লাগায়,
যাদের জীবানু অস্ত্রে শিশুরা মাছের মত ধুকে ধুকে মরে,
যাদের রকেট ঘাটি ঘুমন্ত চোখের কোণে
বিভীষিকা আনে,
যাদের হিংসার শরে নিগারেরা নিত্য বিদ্ধ হয়,
যাদের বেনিয়াবুদ্ধি পৃথিবীর উর্বরতা ক্ষুণ হয়,
যারা রাখে জারজের রক্ত মাংসে
কলুষিত কামনার বীজ;

– সেই ঘৃণ্য দানবের নগ্ন বর্বরতা
ভিয়েতনাম সইবে না, সইবে না দুনিয়ার সংগ্রামী সেনানী।
আফ্রো’শিয়ার গহীন গহনবন, ফেনিল সমুদ্রতীরে।
মরুভর বুক কুঁড়ে অযুত নিযুত কণ্ঠ
বাতাসের হৃদপিণ্ড চিরে চিরে কয়,
– আদিম বর্বর তেজ বলদীপ্ত অহিংস হৃদয়
হিংসায় হিংসায় আজ নব পরিচয়।
তাই ধমনীর শেষে লালে, লিখে যাবো
সংগ্রামের রক্তাক্ত আখর।


তোমারে পেয়ে গেলে বিরাট সমস্যা হয়ে যাইতো কবিতা – প্রীতম কে পাল


তোমারে পেয়ে গেলে বিরাট সমস্যা হয়ে যাইতো কবিতা
প্রীতম কে পাল


তােমারে পেয়ে গেলে শালার বিরাট সমস্যা হয়ে যাইতাে।
সব কথা তােমারে বলা লাগতাে, লিখার মতােন কিছু পাইতাম না।

দুপুরে হয়তাে তােমারে পাইতাম কিন্তু ছারখার করা দুপুর পাইতাম না।
বিকালে হয়তাে তােমার লগে হাঁটা লাগতাে, বিকালের বিষাদ পাইতাম না।
সারারাত তােমার সাথে ফুসফুস করে কথা বলা লাগতাে, রাত আমারে....আর পাইতাে না।
তােমারে পেয়ে গেলে আর আক্ষেপ করার মতাে কিছু থাকতাে না,
আক্ষেপের অভাবে ফাঁকা ফাঁকা লাগতাে।
তােমার দিকে তাকাইলে তােমার চোখে ডুবে যাইতাম, পিঙ্ক ফ্লয়েডে আর ডুবা হইতাে না।
তােমার ভালােবাসা পেয়ে গেলে হয়তাে চায়ের কাপের ভালােবাসা একটু কম কম লাগতাে।
তােমারে পেয়ে গেলে তােমারে না পাওয়ার কষ্ট আর পাওয়া হইতো না তখন ছোটখাটো কষ্ট শালা জ্বালায়ে মারতো।
কাছ থেকে তোমার সৌন্দর্য দেখে ফেললে হয়তো নর্দান লাইটের টর্চলাইট মনে হইতো। 
তোমার চুমু পেয়ে গেলে হয়তো খাবার দাবার সব তিতা তিতা লাগতো, চিকন শরীরে আরো অপুষ্টিতে ভুগতাম।
তোমারে পেয়ে গেলে আর কোনো কিছুর পরোয়া করতাম না তখন জগৎ সংসার ছাড়খার হইয়া যাইতে পারতো।
তাই তোমারে পেয়ে গেলে আসলেই....আসলেই শালার বিরাট সমস্যা হইয়া যাইতো।


সুধাংশু যাবে না কবিতা – শামসুর রাহমান


সুধাংশু যাবে না
শামসুর রাহমান.....ধ্বংসের কিনারে বসে


লুণ্ঠিত মন্দির আর অগ্নিদগ্ধ বাস্তুভিটা থেকে
একটি বিবাগী স্বর সুধাংশুকে ছুঁলো-
‘আখেরে তুমি চলে যাবে?’ বেলাশেষে
সুধাংশু ভস্মের মাঝে খুঁজে
বেড়ায় দলিল, ভাঙা চুড়ি, সিঁদুরের স্তব্ধ কৌটা,
স্মৃতির বিক্ষিপ্ত পুঁতিমালা।

স্বর বলে, ‘লুটেরা তোমাকে জব্দ ক’রে
ফেরে আশে পাশে,
তোমার জীবনে নিত্যদিন লেপ্টে থাকে
পশুর চেহারাসহ ঘাতকের ছায়া,
আতংকের বাদুড়-পাখার নিচে কাটাচ্ছো প্রহর,
তবু তুমি যেও না সুধাংশু।‘

আকাশের নীলিমা এখনো
হয়নি ফেরারী, শুদ্ধাচারী গাছপালা
আজো সবুজের
পতাকা ওড়ায়, ভরা নদী
কোমর বাঁকায় তন্বী বেদিনীর মতো।
এ পবিত্র মাটি ছেড়ে কখনো কোথাও
পরাজিত সৈনিকের মতো
সুধাংশু যাবে না।

১১।১১।৯০


কাজী মোতাহার হোসেন এর কাছে লিখা নজরলের চিঠি


ফজিলাতুন্নেছা কে না পাওয়ার ব্যথায় বেদনা ভেজা বহিঃপ্রকাশ

১৫ জুলিয়াটোলা স্ট্রীট,
কলিকাতা
০৮-০৩-২৮
সন্ধ্যা


প্রিয় মতিহার,

পরশু বিকালে এসেছি কোলকাতা। ওপরের ঠিকানাই আছে। ওর আগেই আসবার কথা ছিলো, অসুখ বেড়ে ওঠায় আসতে পারিনি । দু-চারদিন এখানেই আছি। মনটা কেবলই পালাই পালাই করছে। কোথায় যাই, ঠিক করতে পারছিনে। হঠাৎ কোনোদিন এক জায়গায় চলে যাবো। অবশ্য দু-দশদিনের জন্য। যেখানেই যাই, আর কেউ না পাক; তুমি খবর পাবে।
বন্ধু, তুমি আমার চোখের জলের মতিহার, বাদল রাতের বুকের বন্ধু। যেদিন এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর আর সবাই আমায় ভুলে যাবে, সেদিন অন্তত তোমার বুক বিঁধে ওঠবে। তোমার ওই ছোট্ট ঘরটিতে শুয়ে, যে ঘরে তুমি আমায় প্রিয়ার মত জড়িয়ে শুয়েছিলে; অন্তত এইটুকু সান্ত্বনা নিয়ে যেতে পারবো। এই কী কম সৌভাগ্য আমার!!!

কেন এই কথা বলছি, শুনবে? বন্ধু আমি পেয়েছি। যার সাক্ষাত আমি নিজেই গুণতে পারবো না! এরা সবাই আমার হাসির বন্ধু, গানের বন্ধু, ফুলের সওদার খরিদ্দার এরা। এরা অনেকেই আমার আত্মীয় হয়ে উঠেছে, প্রিয় হয়ে ওঠেনি কেউ। আমার জীবনের সবচেয়ে করুণ পাতাটির লিখা তোমার কাছে লিখে গেলাম। আকাশের সবচেয়ে যে দূরের তারাটির দীপ্তি চোখের জলকণার মত ঝিলমিল করবে, মনে কর, সেই তারাটি আমি। আমার নামেই তার নামকরণ করো, কেমন!

মৃত্যু এত করে মনে করছি কেন? জানো, ওকে আজ আমার সবচেয়ে সুন্দর মনে হচ্ছে বলে! মনে হচ্ছে, জীবনে যে আমায় ফিরিয়ে দিলে, মরলে সে আমায় বরণ করে নেবে। সমস্ত বুকটা ব্যথায় দিনরাত টন টন করছে। মনে হচ্ছে সমস্ত বুকটা যেন ঐখানে এসে জমাট বেঁধে যাচ্ছে। ওর যদি মুক্তি হয়, বেঁচে যাবো। কিন্তু কী হবে, কে জানে!

তোমার চিঠি পেয়ে অবধি কেবল ভাবছি আর ভাবছি। কত কথা, কত কী!! তার কী কূল কিনারা আছে!! ভাবছি আমার ব্যথার রক্ত কে রঙিন খেলা বলে উপহাস যে করে, তিনি হয়তো দেবতা, আমার ব্যথার অশ্রুর বহু উর্ধ্বে। কিন্তু আমি মাটির নজরুল হলেও সে দেবতার কাছে অশ্রুর অঞ্জলি আর নিয়ে যাবোনা।
ফুল ধুলায় ঝরে পড়ে, পায়ে পিষ্ট হয়; তাই বলে কী ফুল এত অনাদরে ? ভুল করে সে ফুল যদি কারোর কবরীতেই ঝরে পড়ে এবং তিনি যদি সেটাকে উপদ্রপ বলে মনে করেন, তাহলে ফুলের পক্ষে প্রায়শ্চিত্ত হচ্ছে, এক্ষুনি কারো পায়ের তলায় পড়ে আত্মহত্যা করা!

সুন্দরের অবহেলা আমি সইতে পারিনা বন্ধু, তাই এত জ্বালা। ভিক্ষা যদি কেউ তোমার কাছে চাইতে আসে, অদৃষ্টের বিড়ম্বনায় তাহলে তাকে ভিক্ষা নাই ই দাও, কুকুর লেলিয়ে দিওনা। আঘাত করবার একটা সীমা আছে। সেটাকে অতিক্রম করলে আঘাত অসুন্দর হয়ে আসে আর তক্ষুনি তার নাম হয় অবমাননা।

ছেলেবেলা থেকেই পথে পথে মানুষ আমি। যে স্নেহে, যে প্রেমে বুক ভরে ওঠে কানায় কানায়, তা কখনো কোথাও পাইনি।
এবার চিঠির উত্তর দিতে বড্ড দেরী হয়ে গেলো। না জানি কতো উদ্বিগ্ন হয়েছ!! কী করি বন্ধু, শরীরটা এত বেশি বেয়াড়া আর হয়নি কখনো। ওষুধ খেতে প্রবৃত্তি হয় না!
আমায় সবচেয়ে অবাক করে নিষুতি রাতের তারা। তুমি হয়ত অবাক হবে, আমি আকাশের প্রায় সব তারাগুলোকে চিনি। তাদের সত্যিকারের নাম জানিনে, কিন্তু তাদের প্রত্যেকের নামকরণ করেছি আমার ইচ্ছে মত। সেই কতো রকম মিষ্টি মিষ্টি নাম, শুনলে তুমি হাসবে। কোন তারা কোন ঋতুতে কোনদিকে উদয় হয়, সব বলে দিতে পারি। জেলের ভিতর যখন সলিডারি সেলে বন্দি ছিলাম, তখন গরমে ঘুম হতো না। সারারাত জেগে কেবল তারার উদয় অস্ত দেখতাম। তাদের গতিপথে আমার চোখের জল বুলিয়ে দিয়ে বলতাম, বন্ধু, ওগো আমার নাম না জানা বন্ধু! আমার এই চোখের জলের পিচ্ছিল পথটি ধরে তুমি চলে যাও অস্ত পাড়ের পানে। আমি শুধু চুপটি করে দেখি। হাতে থাকতো হাতকড়া, দেয়ালের সঙ্গে বাঁধা চোখের জলের রেখা আঁকাই থাকতো মুখে, বুকে। আচ্ছা বন্ধু, ক'ফোঁটা রক্ত দিয়ে এক ফোঁটা চোখের জল হয়? তোমাদের বিজ্ঞান বলতে পারে? এখন শুধু কেবলই জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করে, যার উত্তর নেই, মীমাংসা নেই -সেই সব জিজ্ঞাসা।

যেদিন আমি ওই দূরের তারার দেশে চলে যাবো, সেদিন তাকে বলো, এই চিঠি রেখে সে যেন দু'ফোঁটা চোখের অশ্রুর দর্পণ দেয়, শুধু আমার নামে। হয়ত আমি সেদিন খুশিতে উল্কা ফুল হয়ে তার নতুন খোঁপায় ঝরে পড়বো। তাঁকে বলো, বন্ধু, তাঁর কাছে আমার আর চাওয়ার কিছুই নেই। আমি পেয়েছি, তাঁকে পেয়েছি। আমার বুকের রক্তে, চোখের জলে আমি তাঁর উদ্দেশ্যে আমার শান্ত, স্নিগ্ধ অন্তরের পরিপূর্ণ চিত্তের একটি সশ্রদ্ধ নমষ্কার রেখে গেলাম। আমি যেন শুনতে পাই, সে আমায় সর্বান্তকরণে ক্ষমা করেছে। ফুলের কাঁটা ভুলে গিয়ে তার উর্ধ্বে ফুলের গন্ধই যেন সে মনে রাখে।

ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। স্বপ্ন দেখে জেগে ওঠে আবার লিখছি। কিন্তু আর লিখতে পারছিনে ভাই। চোখের জল, কলমের কালি দুইই শুকিয়ে গেল। তোমরা কেমন আছো, জানিয়ো। তাঁর কিছু খবর দাওনা কেন ? না কী সে এতটুকুও মানা করেছে ? ঠিক সময় মতো সে ওষুধ খায়তো ?
কেবলই কীটস্ কে স্বপ্নে দেখছি। তার পাশে দাঁড়িয়ে ফেনিব্রাউন পাথরের মত। ভালোবাসা নাও।


ইতি
তোমার নজরুল।


নার্গিসকে লেখা কাজী নজরুল ইসলামের চিঠি


নার্গিসকে লেখা কাজী নজরুল ইসলামের চিঠি


কল্যাণীয়াসু,

তোমার পত্র পেয়েছি সেদিন নব বর্ষার নবঘন-সিক্ত প্রভাতে। মেঘ মেদুর গগনে সেদিন অশান্ত ধারায় বারি ঝরছিল। পনের বছর আগে এমনি এক আষাঢ়ে এমনি এক বারিধারায় প্লাবন নেমেছিল, তা তুমিও হয়তো স্মরণ করতে পারো। আষাঢ়ের নব মেঘপুঞ্জকে আমার নমস্কার। এই মেঘদূত বিরহী যক্ষের বাণী বহন করে নিয়ে গিয়েছিল কালিদাসের যুগে, রেবা নদীর তীরে, মালবিকার দেশে, তার প্রিয়ার কাছে। এই মেঘপুঞ্জের আশীর্বাণী আমার জীবনে এনে দেয় চরম বেদনার সঞ্চার। এই আষাঢ় আমায় কল্পনার স্বর্গলোক থেকে টেনে ভাসিয়ে দিয়েছে বেদনার অনন্ত স্রোতে।

যাক, তোমার অনুযোগের অভিযোগের উত্তর দেই। তুমি বিশ্বাস করো, আমি যা লিখছি তা সত্য। লোকের মুখে শোনা কথা দিয়ে যদি আমার মূর্তির কল্পনা করে থাকো, তাহলে আমায় ভুল বুঝবে- আর তা মিথ্যা। তোমার উপর আমি কোনো ‘জিঘাংসা’ পোষণ করিনা –এ আমি সকল অন্তর দিয়ে বলছি। আমার অন্তর্যামী জানেন তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কি গভীর ক্ষত, কি অসীম বেদনা! কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি, তা দিয়ে তোমায় কোনোদিন দগ্ধ করতে চাইনি। তুমি এই আগুনের পরশমানিক না দিলে আমি ‘অগ্নিবীণা’ বাজাতে পারতাম না। আমি ধুমকেতুর বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না। তোমার যে কল্যাণ রূপ আমি আমার কিশোর বয়সে প্রথম দেখেছিলাম, যে রূপকে আমার জীবনের সর্বপ্রথম ভালবাসার অঞ্জলি দিয়েছিলাম, সে রূপ আজো স্বর্গের পারিজাত-মন্দারের মতো চির অম্লান হয়েই আছে আমার বক্ষে। অন্তরের সে আগুন-বাইরের সে ফুলহারকে স্পর্শ করতে পারেনি। তুমি ভুলে যেওনা আমি কবি, আমি আঘাত করলেও ফুল দিয়ে আঘাত করি—অসুন্দর কুৎসিতের সাধনা আমার নয় । আমার আঘাত বর্বরের কাপুরুষের আঘাতের মতো নিষ্ঠুর নয়। আমার অন্তর্যামী জানেন— তুমি কি জান বা শুনেছ জানিনা, তোমার বিরুদ্ধে আজ আমার কোন অনুযোগ নেই, অভিযোগ নেই, দাবীও নেই। তোমার আজিকার রূপ কি জানিনা। আমি জানি তোমার সেই কিশোরি মুর্তিকে, যাকে দেবীমূর্তির মতো আমার হৃদয় বেদীতে অনন্ত প্রেম, অনন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম। সেদিনের তুমি সে বেদী গ্রহণ করলেনা। পাষাণ দেবীর মতই তুমি বেছে নিলে বেদনার বেদিপাঠ …জীবন ভ’রে সেখানেই চলেছে আমার পূজা আরতি। আজিকার তুমি আমার কাছে মিথ্যা, ব্যর্থ; তাই তাকে পেতে চাইনে। জানিনে হয়ত সে রূপ দেখে বঞ্চিত হব, অধিকতর বেদনা পাব, তাই তাকে অস্বীকার করেই চলেছি। দেখা? না-ই হ’ল এ ধূলির ধরায়। প্রেমের ফুল এ ধূলিতলে হয়ে যায় ম্লান, দগ্ধ, হতশ্রী। তুমি যদি সত্যিই আমায় ভালবাসো, আমাকে চাও— ওখান থেকেই আমাকে পাবে। লাইলি মজনুকে পায়নি, শিরি ফরহাদকে পায়নি, তবু তাদের মত করে কেউ কারো প্রিয়তমাকে পায়নি। আত্মহত্যা মহাপাপ, এ অতি পুরাতন কথা হলেও প্রেম সত্য। আত্মা অবিনশ্বর, আত্মাকে কেউ হত্যা করতে পারেনা। প্রেমের সোনার কাঠির স্পর্শ যদি পেয়ে থাকো, তাহলে তোমার মতো ভাগ্যবতী আর কে আছে? তারই মায়াস্পর্শে তোমার সকল কিছু আলোয় আলোময় হয়ে উঠবে।দুঃখ নিয়ে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে গেলেই সেই দুঃখের অবসান হয়না। মানুষ ইচ্ছা করলে সাধনা দিয়ে, তপস্যা দিয়ে ভুলকে ফুল রূপে ফুটিয়ে তুলতে পারে। যদি কোনো ভুল করে থাক জীবনে, এই জীবনেই তাকে সংশোধন করে যেতে হবে; তবেই পাবে আনন্দ মুক্তি; তবেই হবে সর্ব দুঃখের অবসান। নিজেকে উন্নত করতে চেষ্টা করো, স্বয়ংবিধাতা তোমার সহায় হবেন। আমি সংসার করছি, তবু চলে গেছি এই সংসারের বাধাকে অতক্রম করে উর্ধ্বলোকে। সেখানে গেলে পৃথিবীর সকল অপূর্ণতা, সকল অপরাধ ক্ষমা সুন্দর চোখে পরম মনোহর মূর্তিতে দেখা যায়। হঠাৎ মনে পড়ে গেল পনর বছর আগের কথা। তোমার জ্বর হয়েছিল, বহু সাধনার পর আমার তৃষিত দুটি কর তোমার শুভ্র ললাট স্পর্শ করতে পেরেছিল; তোমার তপ্ত ললাটের স্পর্শ যেন আজো অনুভব করতে পারি। তুমি কি চিয়ে দেখেছিলে? আমার চোখে ছিলো জল, হাতে সেবা করার আকুল স্পৃহা, অন্তরে শ্রীবিধাতার চরণে তোমার আরোগ্য লাভের জন্য করুন মিনতি। মনে হয় যেন কালকের কথা। মহাকাল যে স্মৃতি মুছে ফেলতে পারল না। কী উদগ্র অতৃপ্তি, কী দুর্দমনীয় প্রেমের জোয়ারই সেদিন এসেছিল। সারাদিন-রাত আমার চোখে ঘুম ছিল না। যাক আজ চলেছি জীবনের অস্তমান দিনের শেষে রশ্মি ধরে ভাটার স্রোতে, তোমার ক্ষমতা নেই সে পথ থেকে ফেরানোর। আর তার চেষ্টা করোনা। তোমাকে লিখা এই আমার প্রথম ও শেষ চিঠি হোক। যেখানেই থাকি বিশ্বাস করো আমার অক্ষয় আশির্বাদ কবচ তোমায় ঘিরে থাকবে। তুমি সুখি হও, শান্তি পাও— এই প্রার্থনা। আমায় যত মন্দ বলে বিশ্বাস করো, আমি তত মন্দ নই, এই আমার শেষ কৈফিয়ৎ।


ইতি

নিত্য শুভার্থী- নজরুল ইসলাম


কিশোরী নাহারকে লেখা নজরুলের চিঠি


কিশোরী নাহারকে লেখা নজরুলের চিঠি


আগামীকাল ১০ এপ্রিল বেগম শামসুন নাহার মাহমুদের মৃত্যুবার্ষিকী। তার জন্ম ১৯০৮ সালে। মারা যান ১০ এপ্রিল ১৯৬৪ সালে। তিনি ছিলেন এ দেশের নারী মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী, বিশিষ্ট সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ এবং সমাজসেবিকা। মুসলমান সমাজে নারী শিক্ষা প্রসার ও অবরোধপ্রথা রহিত করার জন্য যারা লড়েছেন তিনি তাদের অন্যতম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ছাত্রী হল শামসুন নাহার হল তার নামে নামকরণ করা হয়। কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে তার বেশ হৃদ্যতা ছিল। শাসছুন নাহার যখন কিশোরী তখন ১১ আগস্ট ১৯২৬ সালে নজরুল তাকে একটি চিঠি লেখেন। সে চিঠিতে নজরুলের অনেক অজানা বিষয় উঠে এসেছে। এছাড়া জীবনের নানা দিকও পাওয়া যাবে সে চিঠিতে। নজরুল ইন্সটিটিউট থেকে প্রকাশিত ও শাহাবুদ্দীন আহমদ সম্পাদিত ‘নজরুলের পত্রাবলি’ গ্রন্থ থেকে চিঠিটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো:


স্নেহের নাহার,


কাল রাত্তিরে ফিরেছি কলকাতা হতে। চট্টগ্রাম হতে এসেই কলকাতা গেছিলাম। এসেই পড়লাম তোমার তৃতীয় চিঠি, অবশ্য তোমার ভাবীকে লেখা। আমি যেদিন তোমার প্রথম চিঠি পাই, সেদিনই তখনই কলকাতা যেতে হয় মনে করেছিলাম কলকাতা গিয়ে উত্তর দেবো। কিন্তু কলকাতার কোলাহলের মধ্যে এমনই বিস্মৃত হয়েছিলাম নিজেকে যে কিছুতেই উত্তর দেবার অবসর করে নিতে পারিনি। তাছাড়া ভাই, তুমি অত কথা জানতে চেয়েছ, শুনতে চেয়েছ, যে কলকাতার হট্টগোলের মধ্যে সে বলা যেন কিছুতেই আসত না। আমার বাণী হট্টগোলকে এখন রীতিমত ভয় করে, মূক হয়ে যায় ভীরু বাণী আমার, ওই কোলাহলের অনবকাশের মাঝে। চিঠি দিতে দেরি হল বলে তুমি রাগ করো না ভাই লক্ষ্মীটি। এবার হতে ঠিক সময়ে দেবো, দেখে নিও। কেমন? বাহারটাও না জানি কত রাগ করেছে, কী ভাবছে। আর তোমার তো কথাই নেই, ছেলেমানুষ তুমি, পড়তে না পেরে তুমি এখনো কাঁদ! বাহার যেন একটু চাপা, আর তুমি খুব অভিমানী না? কী যে করেছ তোমরা দুটি ভাই-বোনে যে এসে অবধি মনে হচ্ছে যেন কোথায় কোন নিকটতম আত্মীয়কে আমি ছেড়ে এসেছি। মনে সদাসর্বদা একটা বেদনার উদ্বেগ লেগেই রয়েছে। অদ্ভুত রহস্যভরা এই মানুষের মন! রক্তের সম্বন্ধকে অস্বীকার করতে দ্বিধা নেই যার, সে-ই কখন পথের সম্বন্ধকে সকল হৃদয় দিয়ে অসঙ্কোচে স্বীকার করে নেয়। ঘরের সম্বন্ধটা রক্তমাংসের, দেহের, কিন্তু পথের সম্বন্ধটা হৃদয়ের অন্তরতম-জনার। তাই ঘরের যারা, তাদের আমরা শ্রদ্ধা করি, মেনে চলি, কিন্তু বাইরের আমার-জনকে ভালবাসি, তাকে না-মানার দুঃখ দিই। ঘরের টান কর্তব্যের, বাইরের টান প্রীতির মাধুর্যের। সকল মানুষের মনে সকল কালের এই বাঁধন-হারা মানুষটি ঘরের আঙিনা পেরিয়ে পালাতে চেষ্টা করেছে। যে নীড়ে জন্মেছে এই পলাতক, সেই নীড়কেই সে অস্বীকার করেছে সর্বপ্রথম উড়তে শিখেই! আকাশ আলো কানন ফুল, এমনি সব না-চেনা জনেরা হয়ে ওঠে তার অন্তরতম। বিশেষ করে গানের পাখি যারা, তারা চিরকেলে নিরুদ্দেশ দেশের পথিক। কোকিল বাসা বাঁধে না, বৌ কথা কও;-এর বাসার উদ্দেশ্য আজও মিলল না, উহু উহু চোখ গেল; পাখির নীড়ের সন্ধান কেউ পেল না! ওদের আসা যাওয়া একটা রহস্যের মত। ওরা যেন স্বর্গের পাখি, ওদের যেন পা নেই, ধূলার পৃথিবীতে যেন ওরা বসবে না, ওরা যেন ভেসে আসা গান। তাই ওরা অজানা ব্যথার আনন্দে পাগল হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে দেশে বিদেশে, বসন্ত-আসা বনে, ফুল-ফোটা কাননে, গন্ধ-উদাস চমনে। ওরা যেন স্বর্গের প্রতিধ্বনি টুকরা-আনন্দের উল্কাপিন্ড! সমাজ এদের নিন্দা করেছে, নীতিবাগীশ বায়স তার কুৎসিত দেহ ততোধিক কুৎসিত কণ্ঠনিয়ে এর ঘোর প্রতিবাদ করেছে, এদের শিশুদের ঠুকরে; নিকালো হিঁয়াসে; বলে তাড়িয়েছে, তবু আনন্দ দিয়েছে এই ঘর-না-মানা পতিতের দলই। নীড়-বাঁধা সামাজিক পাখিগুলি দিতে পারল না আনন্দ, আনতে পারল না স্বর্গের আভাস, সুরলোকের গান। এত কথা বললাম কেন, জান? তোমাদের যে পেয়েছি এই আনন্দটাই আমায় এই কথা কওয়াচ্ছে, গান গাওয়াচ্ছে। বাইরের পাওয়া নয়, অন্তরের পাওয়া। গানের পাখি গান গায় খাবার পেয়ে নয়; ফুল পেয়ে আলো পেয়ে সে গান গেয়ে ওঠে। মুকুল-আসা কুসুম-ফোটা বসন্তই পাখিকে গান-গাওয়ায়, ফল-পাকা জ্যৈষ্ঠ আষাঢ় নয়। তখনো পাখি হয়ত গায়, কিন্তু ফুল যে সে ফুটতে দেখেছিল, গন্ধ সে তার পেয়েছিল গায় সে সেই আনন্দে, ফল পাকার লোলুপতায় নয়। ফুল ফুটলে পায় গান, কিন্তু ফল পাকলে পায় ক্ষিদে; আমি পরিচয় করার অনন্ত ঔৎসুক্য নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি মানুষের মাঝে, কিন্তু ফুল-ফোটা মন মেলে না ভাই, মেলে শুধু ফল-পাকার ক্ষুধাতুর মন। তোমাদের মধ্যে সেই ফুল-ফোটানো বসন্ত, গান-জাগানো আলো দেখেছি বলেই আমার এত আনন্দ, এত প্রকাশের ব্যাকুলতা। তোমাদের সাথে পরিচয় আমার কোন প্রকার স্বার্থের নয়, কোন দাবির নয়। ঢিল মেরে ফল পাড়ার অভ্যেস আমার ছেলেবেলায় ছিল, যখন ছিলাম ডাকাত, এখন আর নেই। ফুল যদি কোথাও ফোটে, আলো যদি কোথাও হাসে সেখানে আমায় গান গাওয়ায় পায়, গান গাই। সেই আলো, সেই ফুল পেয়েছিলাম এবার চট্টলায়, তাই গেয়েছি গান। ওর মাঝে শিশিরের করুণা যেটুকু, সেটুকু আমার আর কারুর নয়। যাক, কাজের কথাগুলো বলে নিই আগে। আমায় এখনও ধরেনি, তার প্রমাণ এই চিঠি। তবে আমি ধরা দেওয়ার দিকে হয়তো এগোচ্ছি। ধরা পড়া আর ধরা দেওয়া এক নয়, তা হয়তো বোঝ। ধরা দিতে চাচ্ছি, নিজেই এগিয়ে চলেছি শত্রু-শিবিরের দিকে, এর রহস্য হয়তো বলতে পারি। এখন বলব না। অত বিপুল যে সমুদ্র, তারও জোয়ারভাটা আসে অহোরাত্রি। এই জোয়ার-ভাটা সমুদ্রেই খেলে, আর তার কাছাকাছি নদীতে; বাঁধ-বাঁধা ডোবায়, পুকুরে জোয়ার-ভাটা খেলে না। মানুষের মন সমুদ্রের চেয়েও বিপুলতর। খেলবে না তাতে জোয়ার-ভাটা! যদি না খেলে, তবে তা মানুষের মন নয়। ঐ শান-বাঁধানো ঘাট-ভরা পুকুরগুলোতে কাপড় কাঁচা চলে, ইচ্ছে হলে গলায় কলসি বেঁধে ডুবে মরাও চলে, চলে না ওতে জাহাজ, দোলে না ওতে তরঙ্গ দোলা, খেলে না ওতে জোয়ার-ভাটা; আমি একবার অন্তরের পানে ফিরে চলতে চাই, যেখানে আমার গোপন সৃষ্টি-কুঞ্জ, যেখানে আমার অনন্ত দিনের বধূ আমার জন্য বসে মালা গাঁথছে। যেমন করে সিন্ধু চলে ভাটিয়ালি টানে, তেমনি করে ফিরে যেতে চাই গান-শ্রান্ত ওড়া-ক্লান্ত আমি। আবার অকাজের কথা এসে পড়ল। পুষ্প-পাগল বনে কাজের কথা আসে না, গানের ব্যথাই আসে, আমায় দোষ দিও না। অগ্নিবীনা বেঁধে দিতে দেরি করছে দফতরি, বাঁধা হলেই অন্যান্য বই ও অগ্নিবীনা পাঠিয়ে দেবো একসাথে। ডি. এম. লাইব্রেরিকে বলে রেখেছি। আর দিন দশকের মধ্যেই হয়তো বই পাবে। আমার পাহাড়ে ও ঝর্ণাতলে তোলা ফটো একখানা করে পাঠিয়ে দিও। গ্রুপের ফটো একখানা (যাতে হেমন্তবাবু ও ছেলেরা আছে), আমি, বাহার ও অন্য কে একটি ছেলেকে নিয়ে তোলা যে ফটো তার একখানা এবং আমি ও বাহার দাঁড়িয়ে তোলা ফটোর একখানা পাঠিয়ে দিও আমায়। ফটোর সব দাম আমার বই বিক্রির টাকা হতে কেটে নিও। এখন আবার কোনদিকে উড়ব, ঠিক নেই কিছু। যদি না ধরে কোথাও হয়তো যাব, গেলে জানাব। এখন তোমার চিঠিটার উত্তর দিই। তোমার চিঠির উত্তর তোমার ভাবীই দিয়েছে শুনলাম। আরও শুনলাম, সে নাকি আমার নামে কতগুলো কী সব লিখেছে তোমার কাছে। তোমার ভাবীর কথা বিশ্বাস করো না। মেয়েরা চিরকাল তাদের স্বামীদের নির্বোধ মনে করে এসেছে। তাদের ভুল, তাদের দুর্বলতা ধরতে পারা এবং সকলকে জানানোই যেন মেয়েদের সাধনা। তুমি কিন্তু নাহার, রেগো না যেন। তুমি এখনও ওদের দলে ভিড়নি। মেয়েরা বড্ড অল্পবয়সে বেশি প্রভুত্ব করতে ভালবাসে। তাই দেখি, বিয়ে হবার এক বছর পর ষোল-সতের বছর বয়সেই মেয়েরা হয়ে ওঠে গিনি্ন। তাঁরা যেন কাজে-অকাজে, কারণে-অকারণে-স্বামী বেচারিকে বকতে পারলে বেঁচে যায়। তাই সদাসর্বদা বেচারা পুরুষের পেছনে তারা লেগে থাকে গোয়েন্দা পুলিশের মত। এই দেখ না ভাই, ছটাকখানেক কালি ঢেলে ফেলেছি চিঠি লিখতে লিখতে একটা বই-এর ওপর, এর জন্য তোমার ভাবীর কী তম্বিহ কী বকুনি। তোমার ভাবী বলে নয়, সব মেয়েই অমনি। স্ত্রীদের কাছে স্বামীরা হয়ে থাকে একেবারে বেচারাম লাহিড়ী। একটা কথা আগেই বলে রাখি, তোমার কাছে চিঠি লিখতে কোন সঙ্কোচের আড়াল রাখিনি। তুমি বালিকা এবং বোন বলে তার দরকার মনে করিনি। যদি দরকার মনে কর, আমায় মনে করিয়ে দিও। আমি এমন মনে করে চিঠি লিখিনি, যে কোন পুরুষ কোন মেয়েকে চিঠি লিখছে। কবি লিখছে চিঠি তার প্রতি শ্রদ্ধান্বিতা কাউকে, এই মনে করেই চিঠিটা নিও। চিঠি লেখার কোথাও কোন ত্রুটি দেখলে দেখিয়ে দিও। আ। আমার উচিত আদর করতে পারনি লিখেছ, আর তার কারণ দিয়েছ, পুরুষ নেই কেউ বাড়িতে এবং অসচ্ছলতা। কথাগুলোয় সৌজন্য প্রকাশ করে খুব বেশি, কিন্তু ওগুলো তোমাদের অন্তরের কথা নয়। কারণ, তোমরাই সবচেয়ে বেশি জান যে তোমরা যা আদর-যত্ন করেছ আমার, তার বেশি করতে কেউ পারে না। তোমরা তো আমার কোথাও ফাঁক রাখনি আমার শূন্যতা নিয়ে অনুযোগ করবার। তোমরা আমার মাঝে অভাবের অবকাশ তো দাওনি তোমাদের অভাবের কথা ভাববার; এ আমি একটুও বাড়িয়ে বলছি না। আমি সহজেই সহজ হতে পারি সকলের কাছে, ওটা আমার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি, কিন্তু তোমাদের কাছে যতটা সহজ হয়েছি অতটা সহজ বুঝি আর কোথাও হইনি। সত্যি নাহার আমায় তোমরা আদর-যত্ন করতে পারনি বলে যদি সত্যিই কোন সঙ্কোচের কাঁটা থাকে তোমাদের মনে, তবে তা অসঙ্কোচে তুলে ফেলবে মন থেকে। অতটা হিসেব-নিকেশ করবার অবকাশ আমার মনে নেই, আমি থাকি আপনার মন নিয়ে আপনি বিভোর। মানুষের সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা বলতে বলতেও অন্যমনস্ক হয়ে পড়ি, খেই হারিয়ে ফেলি কথার। আমার গোপনতম কে যেন একেবারে নিশ্চুপ হয়ে থাকতে আদেশ করে। আর আর্থিক অসচ্ছলতার কথা লিখেছ। অর্থ দিয়ে মাড়োয়ারীকে, জমিদার মহাজনকে বা ভিখিরিকে হয়তো খুশি করা যায়, কবিকে খুশি করা যায় না। রবীন্দ্রনাথের পুরস্কার কবিতাটি পড়েছ? ওতে এই কথাই আছে। কবি রাজ-দরবারে গিয়ে রাজাকে মুগ্ধ করে রাজপ্রদত্ত মণি-মাণিক্যের বদলে চাইলে রাজার গলার মালাখানি। কবি লক্ষ্মীর প্যাঁচার আরাধনা কোন কালে করেনি, সরস্বতীর শতদলেরই আরাধনা করেছ তাঁর পদ্মগন্ধে বিভোর হয়ে শুধু গুন্ গুন্ করে গান করেছে আর করেছে। লক্ষ্মীর ঝাঁপির কড়ি দিয়ে কবিকে অভিবন্দনা করলে কবি তাতে অখুশি হয়ে ওঠে। কবিকে খুশি করতে হলে দিতে হয় অমূল্য ফুলের সওগাত। সে সওগাত তোমরা দিয়েছ আমায় অঞ্জলি পুরে। কবি চায় না দান, কবি চায় অঞ্জলি, কবি চায় প্রীতি, কবি চায় পূজা। কবিত্ব আর দেবত্ব এইখানে এক। কবিতা আর দেবতা সুন্দরের প্রকাশ। সুন্দরকে স্বীকার করতে হয় সুন্দর যা তাই দিয়ে। রূপার দাম আছে বলেই রূপা অত হীন; হাটে-বাজারে মুদির কাছে, বেনের কাছে ওজন হতে হতে ওর প্রাণান্ত ঘটল; রূপের দাম নেই বলেই রূপ এত দুর্মূল্য, রূপ এত সুন্দর, এত পূজার! রূপা কিনতে হয় রূপেয়া দিয়ে, রূপ কিনতে হয় হৃদয় দিয়ে। রূপের হাটের বেচা-কেনা অদ্ভুত। যে যত অমনি যে যত বিনা দামে কিনে নিতে পারে, সে তত বড় রূপ-রসিক সেখানে। কবিকে সম্মান দিতে পারনি বলে মনে যদি করেই থাক, তবে তা মুছে ফেল। কোকিল পাপিয়াকে বাড়িতে ডেকে ঘটা করে খাওয়াতে পারনি বলে তারা তো অনুযোগ করেনি কোনদিন। সে কথা ভাবেও নি কোনদিন তারা। তারা তাই বলে তোমার বাতায়নের পাশে গান গাওয়া বন্ধ করেনি। তাছাড়া কবিকে হয়তো সম্মান করা যায় না কাব্যকে সম্মান করা যায়। তুমি হয়তো বলবে, গাছের যত্ন না নিলে ফুল দেয় না। কিন্তু সে যত্নেরও তো ত্রুটি হচ্ছে না। অনাত্মীয়কে লোকে সম্বর্ধনা করে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে; বন্ধুকে গ্রহণ করে হাসি দিয়ে, হৃদয় দিয়ে। উপদেশ আমি তোমায় দিইনি। যদি দিয়ে থাকি, ভুলে যেয়ো। উপদেশ দেওয়ার চাণক্য আমি নই। দিয়েছি তোমার অনাগত বিপুল সম্ভানাকে অঞ্জলি তোমার মাঝের অপ্রকাশ সুন্দরকে প্রকাশ-আলোতে আসার আহ্বান জানিয়েছি শঙ্খধ্বনি করে। উপদেশের ঢিল্ ছুঁড়ে তোমার মনে বনের পাখিকে উড়িয়ে দেবার নির্মমতা আমার নেই, এ তুমি ধ্রুব জেনো। আমি ফুল-ঝরা দিয়ে হাসাই, শাখার মার দিয়ে কাঁদাই নে। তোমায় লিখতে বলেছি, আজও বলছি লিখতে। বললেই যে লেখা আসে, তা নয়। কারুর বলা যদি আনন্দ দেয়, তবে সেই আনন্দের বেগে সৃষ্টি হয়তো সম্ভব হয়ে ওঠে। তোমরা আমায় বলেছ লিখতে। সে-বলা আমায় আনন্দ দিয়েছে, তাই সৃষ্টির বেদনাও জেগেছে অন্তরে। তোমাদের আলোর পরশে শিশিরের ছোঁওয়ায় আমার মনের কুঁড়ি বিকচ হয়ে উঠেছে। তাই চট্টগ্রামে লিখেছি। নইলে তোমরা বললেই লেখা আসত না। তোমার মনের সুন্দর যিনি, তিনি যদি খুশি হয়ে ওঠেন, তাহলে সেই খুশিই তোমায় লিখতে বসাবে। আমার বলা তোমার সেই মনের সুন্দরকে অঞ্জলি দেওয়া। বলেছি, অঞ্জলি দিয়েছি। তিনি খুশি হয়ে উঠেছেন কিনা তুমি জান। তুমি আজও অনেকখানি বালিকা। তারুণ্যের যে উচ্ছ্বাস, যে আনন্দ, যে ব্যথা সৃষ্টি জাগায়, সেই উচ্ছ্বাস, সেই আনন্দ, সেই ব্যথা তোমার জীবনে আসার এখনো অনেক দেরি। তাই সৃষ্টি তোমার আজও উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল না। তার জন্য অপেক্ষা করবার ধৈর্য্য অর্জন করো। তরুর শাখায় আঘাত করলে সে ফুল দেবে না, যখন দেবে সে আপনি দেবে। আমাদের দেশের মেয়েরা বড় হতভাগিনী। কত মেয়েকে দেখলাম কত প্রতিভা নিয়ে জন্মাতে, কিন্তু সব সম্ভাবনা তাদের শুকিয়ে গেল সমাজের প্রয়োজনের দাবিতে। ঘরের প্রয়োজন তাদের বন্দিনী করে রেখেছে। এত বিপুল বাহির যাদের চায়, তাদের ঘিরে রেখেছে বারো হাত লম্বা আটহাত চওড়া দেওয়াল। বাহিরের আঘাত এ দেওয়ালে বারে বারে প্রতিহত হয়ে ফিরল। এর বুঝি ভাঙন নেই অন্তর হতে মার না খেলে। তাই নারীদের বিদ্রোহিনী হতে বলি। তারা ভেতর হতে দ্বার চেপে ধরে বলছে আমরা বন্দিনী। দ্বার খোলার দুঃসাহসিকা আজ কোথায়? তাকেই চাইছেন যুগদেবতা। দ্বার ভাঙার পরুষতার নারীদের প্রয়োজন নেই, কারণ তাদের দ্বার ভিতর হতে বন্ধ, বাহির হতে নয়। তোমারও যে কী হবে বলতে পারিনে। তার কারণ তোমায় চিনলেই তো চলবে না, তোমায় চালাবার দাবি নিয়ে জন্মেছেন যারা তাদের আজও চিনিনি। আমার কেন যেন মনে হলো বাহার তোমার অভিভাবক নয়। ভুল যদি না করে থাকি, তাহলেই মঙ্গল। অভিভাবক যিনিই হন তোমার, তিনি যেন বিংশ শতাব্দীর আলোর ছোঁয়া পাননি বলেই মনে হল। তোমায় যে আজ কাঁদতে হয় বসে বসে কলেজে পড়তে যাবার জন্য, এও হয়তো সেই কারণেই। মিসেস আর এস. হোসেনের মত অভিভাবিকা পাওয়া অতি বড় ভাগ্যের কথা। তাঁকেও যখন তাঁরা স্বীকার করে নিতে পারলেন না, তখন তোমার কী হবে পড়ার, তা আমি ভাবতে পারি নে! তোমার আর বাহারের ওপর আমার দাবি আছে স্নেহ করার দাবি, ভালবাসার দাবি, কিন্তু তোমার অভিভাবকদের ওপর তো আমার দাবি নেই। তবুও ওপর-পড়া হয়ে অনেক বলেছি এবং তা হয়তো তোমার আম্মা ও নানী সাহেবাও শুনেছেন। বিরক্তও হয়েছেন হয়তো। আলোর মত, শিশিরের মত আমি তোমার অন্তরের দলগুলি খুলিয়ে দিতে পারি হয়তো, দ্বারের অর্গল খুলি কি করে? তুমি আমার সামনে আসতে পারনি বলে আমার কোনরূপ কিছু মনে হয়নি। তার কারণ, আমি তোমাকে দেখেছি এবং দেখতে চাই লেখার মধ্য দিয়ে। সেই হল সত্যিকার দেখা। মানুষ দেখার কৌতূহল আমার নেই, স্রষ্টা দেখার সাধনা আমার। সুন্দরকে দেখার তপস্য আমার। তোমার প্রকাশ দেখতে চাই আমি, তোমায় দেখতে চাইনে। সৃষ্টির মাঝে স্রষ্টাকে যে দেখেছে, সেই বড় দেখা দেখেছে। এই দেখা আর্টিস্টের দেখা, ধেয়ানীর দেখা, তপস্বীর দেখা। আমার সাধনা অরূপের সাধনা। সাত সমুদ্দুর তের নদীর পারের যে রাজকুমারীর বন্দিনী সেই রূপকথার অরূপাকে মায়া,- নিদ্রা হতে জাগাবার দুঃসাহসী রাজকুমার আমি। আমি সোনার কাঠির সন্ধান জানি যে সোনার কাঠির ছোঁয়ায় বন্দিনী উঠবে জেগে, রূপার কাঠির মায়ানিদ্রা যাবে টুটে, আসবে তার আনন্দের মুক্তি। যে চোখের জল বুকের তলায় আটকে আছে, তাকে মুক্তি দেওয়ার ব্যথা-হানা আমি। মানস সরোবরের বদ্ধ জলধারাকে শুভ শঙ্খধ্বনি করে নিয়ে চলেছি কবি আমি ভগীরথের মত। আমার পনের আনা রয়েছে স্বপ্নে বিভোর, সৃষ্টির ব্যথায় ডগমগ, আর এক আনা করছে পলিটিক্স, দিচ্ছে বক্তৃতা, গড়ছে সঙ্ঘ। নদীর জল চলছে সমুদ্রের সাথে মিলতে, দুধারে গ্রাম সৃষ্টি করতে নয়। যেটুকু জল তার ব্যয় হচ্ছে দুধারের গ্রামবাসীদের জন্য, তা তার এক আনা। বাকি পনের আনা গিয়ে পড়ছে সমুদ্রে। আমার পনের আনা চলেছে আর চলেছে সৃষ্টি-দিন হতে আমার সুন্দরের উদ্দেশ্যে। আমার যত বলা আমার সেই বিপুলতরকে নিয়ে, আমার সেই প্রিয়তম, সেই সুন্দরতমকে নিয়ে। তোমাকেও বলি, তোমার তপস্যা যেন তোমার সুন্দরকে নিয়েই থাকে মগ্ন। তোমার চলা, তোমার বলা যেন হয় তোমার সুন্দরের উদ্দেশে, তাহলে তোমায় প্রয়োজনের বাঁধ দিয়ে কেউ বাঁধতে পারবে না। তোমার অন্তরতমকে ধ্যান কর তোমার বলা দিয়ে। বাধা যেন তোমার ভিতর দিক থেকে জমা না হয়ে ওঠে। এক কাজ করতে পার, নাহার? তোমার সকল কথা আমায় খুলে বলতে পার? কী তোমার ব্রত, কী তোমার সাধনা এই কথা। আমার কাছে সঙ্কোচ করো না। আমি তাহলে তোমার গতির উদ্দেশ পাব, আর সেই রকম করে তোমায় গড়ে উঠবার ইশারা দিতে পারব। আমি অনেক পথ চলেছি, পথের ইঙ্গিত হয়তো দিতে পারব। তাই বলে আমি পথ চালাব, এ ভয় করো না। বড় বড় কবির কাব্য পড়া এই জন্য দরকার যে তাতে কল্পনার জট খুলে যায়, চিন্তার বদ্ধ ধারা মুক্তি পায়। মনের মাঝে প্রকাশ করতে না পারার যে উদ্বেগ, তা সহজ হয়ে ওঠে। মাটির মাঝে যে পত্র-পুষ্পের সম্ভাবনা, তা বর্ষণের অপেক্ষা রাখে। নইলে তার সৃষ্টি-বেদনা মনের মাঝেই গুমরে মরে। আমার কাছে দামি কথা শুনতে চেয়েছ। দামি কথার জুয়েলার আমি নই। আমি ফুলের বেসাতি করি। কবি বাণীর কমল-বনের বনমালী। সে মালা গাঁথে, সে মণি-মাণিক্য বিক্রি করে না। কবি কথাকে দামি করতে পারে না, সুন্দর করতে পারে। বৌ কথা কও যে কথা কয়, কোকিল যে কথা কয় তার এক কানাকড়ি দাম নেই। ওরা দামি কথা বলতে জানে না। ওদের কথা শুধু গান। তাই বুদ্ধিমান লোক তোতাপাখি পোষে, ময়না পাখি পোষে, ওরা ওদের রোজ রাধা কেষ্ট বুলি শোনায়। আমরা যা বলি, তার মানেও নেই, দামও নেই। তোমায় বুদ্ধিমান লোকের দলের জানিনে বলে এত বকে যাচ্ছি। শুনতে যদি ভাল না লাগে জানিয়ো, সাবধান হব। আমার জীবনের ছোট-খাট কথা জানতে চেয়েছ। বড় মুশকিল কথা ভাই। আমার জীবনের যে বেদনা, যে রং তা আমার লেখায় পাবে। অবশ্য লেখার ঘটনাগুলো আমার জীবনের নয়, লেখার রহস্যটুকু আমার, ওর বেদনাটুকু আমার। ঐখানেই তো আমার সত্যিকার জীবনী লেখা রয়ে গেল। জীবনের ঘটনা দিয়ে কৌতুক অনুভব করতে পার। কিন্তু তা দিয়ে আমাকে চিনতে পারবে না। সূর্যের কিরণ আসলে সাতটা রং রামধনুতে যে রং প্রতিফলিত হয়। কিন্তু সূর্য যখন ঘোরে, তখন তাকে দেখি আমরা শুভ্র জ্যোতির্ময় রূপে। সূর্যের চলাটা প্রতারণা করে আমাদের চোখকে তার বুকের রং দেখতে দেয় না সে। কিন্তু ইন্দ্রধনু যখন দেখি, ওতেই দেখতে পাই ওর গোপন প্রাণের রং। ইন্দ্রধনু যেন সূর্যের লেখা কাব্য। মানুষের জীবনই মানুষকে সবচেয়ে বেশি প্রতারণা করে। রাধা ভালবেসেছিল কৃষ্ণকে নয়, কৃষ্ণের বাঁশিকে। তোমরাও ঠিক ভালবাস আমাকে নয় আমার সুরকে, আমার কাব্যকে। সে তো তোমাদের সামনেই রয়েছে। আবার আমায় নিয়ে কেন টানাটানি, ভাই? সূর্যের কিরণ আলো দেয়, কিন্তু সূর্য নিজে হচ্ছে দগ্ধ দিবানিশি। ওর কাছে যেতে যে চায় সেও হয় দগ্ধীভূত। আলো সওয়া যায়, শিখা সওয়া যায় না। আমি জ্বলছি শিখার মতো, আপনার আনন্দে আপনি জ্বলছি, কাছে এলে তা দেয় দাহ, দূর হতে দেয় আলো। তোমাদের কাছে ছিলাম যে-আমি, সেই-আমি আর চিঠির-আমি কি এক? তোমরা কবিকে জানতে চাও, না নজরুল ইসলামকে জানতে চাও, তা আগে জানিও; তাহলে আমি এর পরের চিঠিতে একটু একটু করে জানাব তার কথা। চাঁদ জোছনা দেয়, কথা কয় না বহু চকোর-চকোরীর সাধ্য-সাধনাতেও না। ফুল মধু দেয়, গন্ধ দেয়, কথা কয় না বহু ভ্রমরার সাধ্য সাধনাতেও না। বাঁশি কাঁদে, যখন গুণীর মুখে তার মুখে চুমোচুমি হয়; বাকি সময়টুকু সে এক কোণে নির্বাক, নিশ্চুপ হয়ে পড়ে থাকে। একই ঝড়ের বাঁশ ভাগ্যদোষে বা গুণে কেউ হয়ে ওঠে লাঠি, কেউ হয় বাঁশি। বীণা কত কাঁদে, কথা কয় গুণীর কোলে শুয়ে, বাকি সময়টুকু তার খোলের মধ্যে আপনাকে হারিয়ে সে নিষ্পন্দিত হয়ে থাকে। গানের পাখি, তাকে গানের কথাই জিজ্ঞাসা কর, নীড়ের কথা জিজ্ঞাসা করো না। নিজেই বলতে পারবে না যে, কোথায় ছিল তার নীড়। জন্ম নিয়ে গান শিখে উড়ে যাবার পর নীড়টার মতো অপ্রয়োজনীয় জিনিস আর তার কাছে নেই। নীড়ের পাখি তখন বনের পাখি হয়ে ওঠে। গুরুদেব বলেছেন, ফসল কেটে নেবার পর মাঠটার মতো অপ্রয়োজনীয় জিনিস আর নেই। তবু সেই অপ্রয়োজনের যদি প্রয়োজন অনুভব করে তোমাদের কৌতুক, তবে জানিয়ো। চিঠি লিখছি আর গাচ্ছি একটা নতুন লেখা গানের দুটো চরণ:


"হে ক্ষণিকের অতিথি,
এলে প্রভাতে কারো চাহিয়া
ঝরা শেফালির পথ বাহিয়া।
কোন্ অমরার বিরহি
নীরে চাহনি ফিরে,
কার বিষাদের শিশির-
নীরে এলে নাহিয়া।"

কবির আসা ঐ শেফালির পথ বেয়ে আসা। কার বিষাদের শিশির-জলে নেয়ে আসে তা সে জানে না। তার নিজের কাছেই সে একটা বিপুল রহস্য। আমার লেখা কবিতাগুলো চেয়েছ। হাসি পাচ্ছে খুব কিন্তু। কী ছেলে-মানুষ তোমরা দুটি ভাই বোন। যে-খন্তা নিয়ে মাটি খোঁড়ে মালী, সেটারও যে দরকার পড়ে ফুলবিলাসীর, এ আমার জানা ছিল না। যে পাতার কোলে ফুল ফোটে, সে-পাতা কেউ চায় না, এই আমি জানতাম। মালা গাঁথা হবার পর ফুল-রাখা পদ্ম-পাতাটার কোন দরকার থাকে, এও একটা খুব মজার কথা, না? যাক্, চেয়েছো দেবো। তবে এ পল্লব শুকিয়ে উঠবে দুদিন পরে, থাকবে যা তা ফুলের গন্ধ। তাছাড়া অত কবিতাই বা লিখব কোত্থেকে যে খাতা ভর্তি করে দেবো। বসন্ত তো সব সময় আসে না। শাখার রিক্ততাকে যে ধিক্কার দেয়, সে অসহিষ্ণু; ফুল ফোটার জন্যে অপেক্ষা করতে জানে যে, সে-ই ফুল পায়। যে অসহিষ্ণু চলে যায়, সে তো পায় না ফুল, তার ডালা চিরশূন্য রয়ে যায়। তোমাদের ছায়া-ঢাকা, পাখি-ডাকা দেশ, তোমাদের সিন্ধু পর্বত গিরিদরী-বন আমায় গান গাইয়েছিল। তোমাদের শোনার আকাঙ্ক্ষা আমায় গান গাইয়েছিল। রূপের দেশ ছাড়িয়ে এসেছি এখন রূপেয়ার দেশে, এখানে কি গান জাগে? বীণাপাণির রূপের কমল এখানকার বাস্তবতার কঠোর ছোঁয়ায় রূপার কমল হয়ে উঠেছে। কমলবনের বীণাপাণী ঢুকেছেন এখানের মাড়োয়ারী মহলে। ছাড়া যেদিন পাবেন, আসবেন তিনি আমার হৃদকমলে। সেদিনের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই আমার। আমার কবিতার উৎস-মুখের সন্ধান চেয়েছ। তার সন্ধান যতটুকু জানি নিজে দেখিয়ে দেবো। আর কিছু লিখবার অবসর নেই আজ। মানস-কমলের গন্ধ পাচ্ছি যেন, কেমন যেন নেশা ধরছে; বোধ হয় বীণাপাণি তার চরণ রেখেছেন এসে আমার অন্তর-শতদলে। এখন চললাম ভাই। চিঠি দিও আমার আশীস্ নাও।


ইতি,
তোমার নুরুদা


পুনশ্চ,
তোমাদের অনেক কষ্ট দিয়ে এসেছি, সে সব ভুলে যেও। তোমার আম্মা ও নানী সাহেবার পাক কদমানে হাজার হাজার আদাব জানাবে আমার। শামসুদ্দিন ও অন্যান্য ছেলেদেরে স্নেহাশিস জানাবে। তুমি কি বই পড়লে এর মধ্যে বা পড়ছ, কি কি লিখলে, সব জানাবে। তোমার লেখাগুলো আমায় আজই পাঠিয়ে দেবে চিঠি দিতে দেরি করো না। কালিকলম পেয়েছ বোধ হয়। তোমায় পাঠানো হয়েছে। তোমার লেখা চায় তারা। নুরুদা...