যশোর রোড
অ্যালেন গিন্সবার্গ
কাব্যানুবাদ দিলদার হোসেন
লাখো কচিমুখ উর্ধ্বগগনে চেয়ে,
ফোলা পেটে তারা গোলক বোবা চোখে
বাঁশের মাচানে যশোর রোডের ধারে
প্রকৃতির ডাকে বালু নালার পাড়ে
লাখো পিতারা ঝুমবৃষ্টিতে ভিজে,
লাখো মাতারা জঠর ব্যথায় কাঁদে
লাখো পিতারা ঝুমবৃষ্টিতে ভিজে,
লাখো মাতারা জঠর ব্যথায় কাঁদে
লাখো ভাইয়েরা দুঃখের নাচনে কাবু,
লাখো বোনেরা আবাসহীন রাতে
লাখো মাসিপিসি ক্ষুধার জ্বালায় ঝরে,
লাখো মামা কাকা লাশের শোকে মরে
লাখো পিতামহ ঘরহারা চিরদুঃখী,
লাখো মাতামহ উন্মাদ হয়ে বধির
লাখো কন্যারা হেঁটে যায় কাদামাটি,
লাখো শিশুরা ভিজে যায় বন্যায়
লাখো বালিকার বমি ক্ষুধা কান্নায়,
লাখো পরিবার আশাহীন বিসর্জন
লাখো হৃদয়ে ১৯৭১,
সূর্য খরায় যশোর রোডের বুকে
লাখো মানবের হঠাৎ মৃত্যু আসে
লাখো মানবেরা ধাবমান কলকাতায়
যশোর রোডে ট্যাক্সি চলেছে ভয়ে,
কয়লার গাড়ি টানে কঙ্কালসার গরু
কর্দমাক্ত ডোবা মাঠে ছুটে চলা,
গোবর জ্বালানি লেপ্টে আছে কুটিরে
জবুথবু মিছিলের মুখগুলো
বোবা চাহনিতে বালকের দল তাকায়
কঙ্কাল মুখ নৈঃশব্দের প্রতিবাদে,
ক্ষুধার্ত কালে দেবদূত মানব সাজে
মায়ের কান্না, কোলের শিশুরা কাঁদে,
সন্ন্যাসিনী হয়ে ক্ষয়ে যাওয়া দহনকালে
কচি মুখে প্রার্থনা-জীব দিয়েছেন যিনি,
এ কেমন চড়ুই খাবারে আঁকড়েড়ে বেঁচে থাকা
ছিন্ন চাটাইয়ে শূন্য বাটিতে বসে
কম্পিত হাতে তুলে ধরে পিতামাতা
হায়! চোখ ফেটে আসে জল,
কান্দে মাতা নীরব যন্ত্রণার অশ্রুজলে
দুজন শিশু বসা পাতার ছায়ায়
নিস্তব্ধতায় আজ যদি কিছু পাওয়া
সপ্তাহান্তে চাল ডাল যদি মেলে,
গুঁড়োদুধ আর নেবে না শিশু বোবা রায়ে
টাকা, তরকারি, নেইতো কাজ পুরুষ যারা,
যা ছিলো চাল চারদিন গেল অন্নছাড়া
দিনে দিনে উপোস থেকে অন্নহারা,
যতটুকু পায় উগরিয়ে দেয় পাগলপারা
কান্দে মাতা যশোর রোডে ঠেকিয়ে মাথা,
বাংলায় তারা বলছে- সাহেব একচ দয়া!
উঠোন মাকে! পড়ে থাকে ছিন্ন খাদ্যকার্ড,
ক্যাম্পের প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়ে সারারাত
শিশুরা বন্যাজলে খেলতে থাকে,
কেউ জানে না আজকে তাদের উদোম থাকা
এসব খুঁটিনাটি ফ্রেমবন্দী ছবিতে আছে,
শিশুর কান্নাখেলা আনবে তারা ধ্বংসলীলা
সান্ত্রী সেপাই ঘিরে আছে হাজার বালক,
অপেক্ষার শেষে যদি খাদ্য আসে
হুইসেল আর বাঁশের লাঠি বেজায় জোরে
ক্ষুধার খেলা থামায় তারা জোরসে মেরে
সারি ভেঙ্গে এলোমেলো লাফিয়ে আগায়
ভিড়ের ভিড়ের মাঝে হঠাৎ এক শীর্ণ মানুষ
কাদার মঞ্চে এগিয়ে যায় হুলাবোলে
হুরীরা ধরপাকড়ে এগিয়ে আসে
শিশুরা কেনো জড়ো হয়েছে এই ভূমিতে,
হেসে খেলে আঁকড়ে ধরেছে কেন এই মাটিতে
কোন প্রতীক্ষার আনন্দে সময় এসে
নিয়ে যাবে ওদের ভেন্না পাতার ঘরে
রুটিওয়ালা খুপরির মুখে বর্জন করে,
বেসুরো শব্দে শিশুরা সন্ত্রস্ত সদলবলে
নাই কোন রুটি আনন্দ প্রার্থনায়,
সমস্বরে শিশুরা বলে বাহু এইতো বেশ
দৌড়ে গিয়ে গুরুজনে করে মিনতি
রাষ্ট্রের রুটি ব্যবস্থার কী খবর বলো?
আজ খাদ্যহীন আর আশ্রয়হীন এই তল্লাটে,
বেদনাহত অসুস্থ শিশুর জীর্ণ ছোঁয়ায়
মাসের পর মাস পুষ্টিহীন এই শরীরে,
দাস্ত বমিতে শূন্যদেহে ক্ষুধার্ত তারা
জীবাণুযুক্ত স্বাস্থ্যকার্ডে হতাশ তারা,
সিরাপের প্রয়োজন নয়তো পরিণতি ভরা
শরণার্থী পল্লী হাসপাতালে রূপ নিয়েছে,
সদ্যজাত শিশু মায়ের শীর্ণ গায়ে শোয়া
বানরের মতো দুর্বল চোখ কোটরে গেছে,
এই রক্তক্ষরণে হাজার মৃত্যুর প্রতিধ্বনি
রিকশায় চেপে যশোর রোডে যদিও তাকাই,
চেয়ে দেখি অর্ধ লক্ষ মানব পাঁজর ছবি
সারি সারি বাঁশের মাচান আর যে মাঠ,
নালা নর্দমায় শিশু পরিবার খাদ্যের অপেক্ষায়
সীমান্তে ট্রাক, থৈথৈ পানি, খাদ্য নাই
হে আমেরিকান দেবদূত রাষ্ট্রযন্ত্র
এখনই দেখো, দেখো,
কোথায় তোমার কূটনৈতিক বাচালবুলি?
মেশিনগানের খেলাতে কেন মারছো অবুঝ শিশু?
কোথায় তোমার সাহায্যকারী জঙ্গি ধাতবপাখি?
কোথায় আমেরিকার আলোকিত বায়ুসেনার দল?
তারা কি উত্তর লাওসে দিনরাত্রি ফেলছে বোমা?
কোথায় স্বর্ণখচিত রাষ্ট্রপতির সমরসেনা,
কোথায় লক্ষকোটি গর্বিত নৌসেনার দল
তাদের দিয়ে খাদা ঔষধ এখনই এনে দাও।
কেন কষ্ট বাড়িয়ে ভিয়েতনামে ফেলো নাপাম
কোথায় মেয়েরা চোখ ছলছল প্রিয়জন?
কোথায় হারায় প্রিয়জন মলিন বৃষ্টি কাদায়
শিশুরা সব তাকিয়ে থাকে যশোর রোডের দিকে,
চোখের সামনে মৃত্যুর সারি কোথায় হবে ঠাঁই
কার কাছে বলি ভাত কাপড় আর যত্নের প্রয়োজন,
কোন বন্ধুরা এনে দেবে আজ ক্ষুধামুক্তির পথ
দোখা লক্ষ শিশুরা একাকী কাটায় বৃষ্টিতে,
দেখো লক্ষ শিশুরা ব্যথায় কাতর দৃষ্টিতে
দুঃখের প্রতিবাদে জাগো ভুবন কন্ঠস্বর,
দুঃখকে ভালোবাসায় পরিণত করে অজানা প্রিয়জন
ক্ষুধার জ্বালায় অণুপরমাণু তোলে কাঁসর ধ্বনি,
জাগাও আমেরিকা সচেতন মানব মস্তিত্ব যারা
কত শিশু কত প্রাণ ঝরে যায় হায়,
কত কন্যা শিশুরা অশরীরী হয়ে পড়ে
আমাদের আমরা অযতনে করি নিঃশেষ,
দুঃখের কান্নায় তোলো আজ সুরের ঝংকার
কাদাপানিতে মাচানগুলো ভেড়ে যায় কান্নায়,
অসংখ্য চোখ ঘুমায় বৃষ্টিতে মাঠের মাটিতে
সভ্য মানুষকে ধিক্কার দেয় পানির ইদারা ঘিরে
এখনো ক্ষুধার্ত মায়ের কোলে তারা অসহায়
আমি অতীতে যা করেছি তাই কি করছি?
কবি সুনীল, বলো আমি কী করবো এখন?
টাকা কড়ি দিতে না পেরে ছেড়ে চলে যাবো নাকি?
মানবিক ভালোবাসায় কী করবো বলো কবি?
সাজানো শহর আর গাড়ি দিয়ে কী হবে?
মঙ্গলগ্রহে পা দিতে কী কী কিনবো বলো
কত লক্ষ মানুষ সুখের নিদ্রায় কাটায় নিউইয়র্কে,
আর সুস্বাদু সুপে শুকর ভাজা গিলে গিলে খায়
কত জারক রসে উন্মত্ত ভণ্ড হবে তুমি?
মা, সাগরের বুকে রক্তের হোলি খেলে
দিগার পেট্রোল নতুন গাড়ির স্বপ্নে বিভোর হবে।
পচা দুর্গন্ধে এই চরাচরে নক্ষত্রের আলো হারায়
থামাও এ যুদ্ধ, বুকের উষ্ণ নিঃশ্বাসে
মানব চোখের নোনা জলের স্বাদ নিও চেখে
লক্ষ আবছায়ায় নিমজ্জিত এই মানববাগান
গ্রহের দূরবীক্ষণে দোষে মত্ত নরকের সংসার
আরো লক্ষ শিশু এখনো ঘরণ কামড়ে।
সৃষ্টিকর্তার সহানুভূতিতে এই দুঃখী মায়েরা
কত পিতাদের কষ্টের টাকায় এই মৃত্যুখেলা,
কত শিশুদের ফৌজি নিশানায় সাল হবে বেলা
বিভ্রাবেদনে আর কত আত্মার পথ চলা,
কত শিশুরা মায়ার খেলায় বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে
কত পরিজন কোঠরে চোখে যায় হারিয়ে,
কত মাতামহ বিপন্ন হয়ে অশরীরী বাঁচে
এত ভালোবাসায় কি রুটির যোগান হবে?
কত কাকা মামারা ছবি হয় মায়াজালে?
কত প্রিয় বোনের বিছানো নিত্য খুলি,
কত পিতামহের পীড়িত বদ্ধবাকে
আর কত বাবার দুঃখের কান্না শুনি,
আর কত পুত্রের দিকশূন্য পথে চলা
আর কত কন্যাদের দুঃখের কাতরতা,
আর কত কাকাদের জর্জরিত পদযুগল
লক্ষ শিশুরা কাঁদে সীমাহীন যন্ত্রণায়,
লক্ষ মাতার শরীর বৃষ্টিতে ভিজে যায়
লক্ষ ভাইয়েরা দুঃখের সাগরে ডুবে,
লক্ষ বালক বালিকা বাস্তুহীন অজানায় পথ চলে।
আবৃত্তি
আবৃত্তি করেছেনঃ শামসউজজোহা
No comments:
Post a Comment