রিকশাওয়ালা কবি, বইও বেরিয়েছে দুটো!
ইমু ইমরান কায়েস
বনশ্রী যাবেন?
বনশ্রী তো চিনিনা চিনায়া নিয়েন,
নতুন জায়গা না গেলে আর চিনমু ক্যামনে।
খাঁটি কথা।
টিএসসির মোড় থেকে যখন রিকশা ঠিক করি
তখন অন্ধকার হয়ে গেছে ঢাকা শহর, বাড়ি ফেরার তাড়া,
তাই অচিন রিকশাওয়ানাই সই।
প্রত্যেক মোড়ে ডান-বান বলতে বলতে চলার পথের অবিন্যস্ত আলসেমি,
অহেতুক সব চিন্তা-ভাবনার বিলাসিতা কেটে যাবে, যাক।
রাতের ঢাকা এখন আর খুব নিরাপদ না
চার দেয়ালে ফেরা দরকার, ঘরে ফেরা দরকার।
শাহজানপুর এসে ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ি কি না। বললাম, পড়ি না।
ডাক্তারি করি, রিকশাওয়ালার ফের বিনীত জিজ্ঞাসা
দেশেই থাকবেন, না বিদেশ চইলা যাবেন?
বললাম, দেশেই থাকবো, অর্ধেক জীবন শেষ,
নতুন করে আর কই যাবো।
দেশের অবস্থা তো ভালো না,
মানুষজন ভালো না, শিক্ষা নাই, সচেতনতা নাই,
থাইকা কি করবেন তার গলায় আক্ষেপ এবার!
আমি এইবার বিস্মিত হলাম,
রিকশাওয়ালার গলায় এই ধরনের সূক্ষ রুচিশীল হাহাকার তো থাকার কথা নয়,
সামথিং ইজ নট রাইট।
সত্যিকার অর্থেই নড়েচড়ে বসলাম।
আলো অন্ধকারে কেবল ঘামে ভেলা পিঠটুকু দেখা যাচ্ছে তার। ওঠার সময় চেহারা খেয়ালই করিনি।
সত্তা শার্টে লেপ্টে থাকা পিঠ থেকে কোন অ্যাবনর্মাল কিছু উদ্ধার করা গেল না।
এই দেশের মেইন সমস্যা কী ভাই জানেন?
সমস্যা তো অনেক।
ঘুষ, দুই নম্বরি, বিচার না হওয়া, প্রভাবশালীদের যা ইচ্ছা তাই করা, ধর্ম ইউজ করে হাবিজাবি কাজ করা, একে তাকে রাজাকার, একে তাকে নাস্তিক বানানো, বাজে রাজনীতি, তার মতে কোনটা কে জানে।
তাই জবাব না দিয়ে আমিই জিজ্ঞেস করলাম, কী?
এবার ভদ্রলোকের উত্তর শুনে ভিমড়ি খেলাম-
"মেইন সমস্যা হচ্ছে কেউ বই পড়ে না।"
তাকে জিজ্ঞেস করলাম, "আপনি পড়েন?"
অত না, টুকটাক।
আমি আবার কবিতার বই একটু বেশি পড়ি।
বলেন কী।
বিস্ময়ের মাত্রা বেড়ে রিকশা থেকে পড়ে যাওয়ার যোগাড় হয় আমার।
কার কবিতার বই পড়েন?
ভদ্রলোক প্রবল মমতায় জানান,
তার পছন্দের কবি শক্তি চট্টোপধ্যায় আর ফরাসী কবি আর্তুর ব্যাবো।
খিলগাঁওয়ের গলিতে আকাশ ফুড়ে হঠাৎ একটা পাহাড় সম উঁচু জ্বিন এসে যদি পথ রোধ করে দাঁড়াতো তবু এতো চমকাতাম না। আর্তুর র্যাবো, শক্তি।
কি বিস্ময়! কি বিস্ময়।
ভজলোকের নাম শ্রিপান্থ শফিক।
আপনার অনুমান ঠিক আছে, শ্রিপাছ টুক বানানো।
বরিশালের একেবারে ভেতর থেকে উঠে আসা একটা মানুষকে ওইটুকু মেলোড্রামা করতে দেয়াই যায়।
ছাত্র খারাপ ছিলেন না।
এসএসসি পরীক্ষার পর কবিতার 'ভূতে ধরলো।
আরজ আলী মাতুব্বর, সক্রেটস, স্টিফেন হকিং, শক্তি, র্যাবো, গিয়ম এপোলোনিয়ার, হুমায়ুন আজাদ পড়ার পর তার মনে হল
জীবন এক আশ্চর্য গিফট।
স্কুল কলেজে পড়ে সেইটা নষ্ট করার কোন মানে হয় না।
তাই আর পড়েননি! কবিতা লেখেন নিয়মিত, দুইটা বইও বেরিয়েছে।
যে জীবন তিনি যাপন করেন, তার মতে এটা প্রথা বিরোধী জীবন। একটা সেন্স অফ ফ্রিডম তো আছে!
খারাপ কী?
বাসার কাছাকাছি এসে ভদ্রলোকের সাথে কফি খেলাম এক কাপ।
কফি খেতে খেতে মনে হল, আহা জীবন!
কেউ কি ভীষণ দুঃসাহস নিয়ে জন্মায়!
আর কেউ কি করুণভাবে মাথা নত করে মেনে নেয় জাগতিক সমস্ত হিসাব।
ভদ্রলোকের প্রতি বুক ভর্তি হিংসা নিয়ে বাড়ি ফিরলাম!
আবৃত্তি
আবৃত্তি করেছেনঃ ফারাবি হাফিজ
No comments:
Post a Comment