কবিতা ভাণ্ডার
বাংলা কবিতা, ছোটদের কবিতা, ছড়া-কবিতা, বাংলা প্রেমের কবিতা, জনপ্রিয় কবিতা, নতুন কবিদের কবিতা, খ্যাতিমান বাঙালী কবিদের কবিতা পড়ুন কবিতা ভাণ্ডারে। কবিতা ভাণ্ডার একটি নির্ভেজাল বাংলা কবিতা প্রকাশের প্লাটফর্ম।
সবিতা কবিতা – জীবনানন্দ দাশ
সবিতা
তুমি কবিতা – জীবনানন্দ দাশ
তুমি
জীবনানন্দ দাশ.....বনলতা সেন
নক্ষত্রের চলাফেরা ইশারায় চারিদিকে উজ্জ্বল আকাশ;
বাতাসে নীলাভ হ’য়ে আসে যেন প্রান্তরের ঘাস;
কাঁচপোকা ঘুমিয়েছে— গঙ্গাফড়িং সে-ও ঘুমে;
আম নিম হিজলের ব্যাপ্তিতে প’ড়ে আছো তুমি।
‘মাটির অনেক নিচে চ’লে গেছো? কিংবা দূর আকাশের পারে
তুমি আজ? কোন্ কথা ভাবছো আঁধারে?
ওই যে ওখানে পায়রা একা ডাকে জামিরের বনে:
মনে হয় তুমি যেন ওই পাখি— তুমি ছাড়া সময়ের এ-উদ্ভাবনে
আমার এমন কাছে— আশ্বিনের এত বড়ো অকূল আকাশে
আর কাকে পাবো এই সহজ গভীর অনায়াসে—’
বলতেই নিখিলের অন্ধকার দরকারে পাখি গেল উড়ে
প্রকৃতিস্থ প্রকৃতির মতো শব্দে— প্রেম অপ্রেম থেকে দূরে।
ভিখিরী কবিতা – জীবনানন্দ দাশ
ভিখিরী
জীবনানন্দ দাশ.....বনলতা সেন
একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি আহিরীটোলায়,
একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি বাদুড়বাগানে,
একটি পয়সা যদি পাওয়া যায় আরো—
তবে আমি হেঁটে চ’লে যাবো মানে-মানে।—
ব’লে সে বাড়ায়ে দিলো অন্ধকারে হাত।
আগাগোড়া শরীরটা নিয়ে এক কানা যেন বুনে যেতে চেয়েছিলো তাঁত;
তবুও তা নুলো শাঁখারীর হাতে হয়েছে করাত।
একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি মাঠকোটা ঘুরে,
একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি পাথুরিয়াঘাটা,
একটি পয়সা যদি পাওয়া যায় আরো—
তা হ’লে ঢেঁকির চাল হবে কলে ছাঁটা।
—ব’লে সে বাড়ায়ে দিলো গ্যাসলাইটে মুখ।
ভিড়ের ভিতরে তবু— হ্যারিসন রোডে— আরো গভীর অসুখ,
এক পৃথিবীর ভুল; ভিখিরীর ভুলে: এক পৃথিবীর ভুলচুক।
তোমাকে কবিতা – জীবনানন্দ দাশ
তোমাকে
জীবনানন্দ দাশ.....বনলতা সেন
মেঠো চাঁদ কবিতা – জীবনানন্দ দাশ
মেঠো চাঁদ
জীবনানন্দ দাশ.....ধূসর পাণ্ডুলিপি
মেঠো চাঁদ রয়েছে তাকায়ে
আমার মুখের দিকে, ডাইনে আর বাঁয়ে
পোড়ো জমি—খড়—নাডা—মাঠের ফাটল,
শিশিরের জল।
মেঠো চাঁদ—কাস্তের মতো বাঁকা, চোখা—
চেয়ে আছে; এমনি সে তাকায়েছে কতো রাত—নাই লেখা-জোখা।
মেঠো চাঁদ বলে:
‘আকাশের তলে
খেতে-খেতে লাঙলের ধার
মুছে গেছে—ফসল-কাটার
সময় আসিয়া গেছে—চ’লে গেছে কবে!
শস্য ফলিয়া গেছে—তুমি কেন তবে
রয়েছো দাঁড়ায়ে
এক-একা! ডাইনে আর বাঁয়ে
খড়-নাড়া—পোড়ো জমি—মাঠের ফাটল,
শিশিরের জল!’ .....
আমি তারে বলি:
‘ফসল গিয়েছে ঢের ফলি,
শস্য গিয়েছে ঝ’রে কতো—
বুড়ো হ’য়ে গেছ তুমি এই বুড়ী পৃথিবীর মতো!
খেতে-খেতে লাঙলের ধার
মুছে গেছে কতোবার—কতোবার ফসল-কাটার
সময় আসিয়া গেছে, চ’লে গেছে কবে!
শস্য ফলিযা গেছে—তুমি কেন তবে
রয়েছো দাঁড়ায়েএকা-একা! ডাইনে আর বাঁয়ে
পোড়ো জমি—খড়-নাড়া—মাঠের ফাটল,
শিশিরের জল!’
পেঁচা কবিতা – জীবনানন্দ দাশ
পেঁচা
জীবনানন্দ দাশ.....ধূসর পাণ্ডুলিপি
পঁচিশ বছর পরে কবিতা – জীবনানন্দ দাশ
পঁচিশ বছর পরে
জীবনানন্দ দাশ.....ধূসর পাণ্ডুলিপি
শেষবার তার সাথে যখন হয়েছে দেখা মাঠের উপরে—
বলিলাম—‘একদিন এমন সময়
আবার আসিও তুমি—আসিবার ইচ্ছা যদি হয়—
পঁচিশ বছর পরে।’
এই ব’লে ফিরে আমি আসিলাম ঘরে;
তারপর, কতোবার চাঁদ আর তারা
মাঠে-মাঠে ম’রে গেল, ইঁদুর-পেঁচারা
জ্যোৎস্নায় ধানখেত খুঁজে
এলো গেল; চোখ বুজে
কতোবার ডানে আর বাঁয়ে
পড়িল ঘুমায়ে
কতো-কেউ; রহিলাম জেগে
আমি একা; নক্ষত্র যে-বেগে
ছুটিছে আকাশে
তার চেয়ে আগে চ’লে আসে
যদিও সময়,
পঁচিশ বছর তবু কই শেষ হয়!
তারপর—একদিন
আবার হলদে তৃণ
ভ’রে আছে মাঠে,
পাতায়, শুকনো ডাঁটে
ভাসিছে কুয়াশা
দিকে-দিকে, চড়ুয়ের ভাঙা বাসা
শিশিরে গিয়েছে ভিজে—পথের উপর
পাখির ডিমের খোলা, ঠাণ্ডা—কড়্কড়্;
শসাফুল—দু-একটা নষ্ট শাদা শসা,
মাকড়ের ছেঁড়া জাল—শুক্নো মাকড়
সালতায়—পাতায়;
ফুটফুটে জ্যোৎস্নারাতে পথ চেনা যায়;
দেখা যায় কয়েকটা তারা
হিম আকাশের গায়—ইঁদুর-পেঁচারা
ঘুরে যায় মাঠে-মাঠে, খুদ খেয়ে ওদের পিপাসা আজো মেটে,
পঁচিশ বছর তবু গেছে কবে কেটে!
আকাশলীনা কবিতা – জীবনানন্দ দাশ
আকাশলীনা
জীবনানন্দ দাশ.....সাতটি তারার তিমির
কার্তিক মাঠের চাঁদ কবিতা – জীবনানন্দ দাশ
কার্তিক মাঠের চাঁদ
জীবনানন্দ দাশ.....ধূসর পাণ্ডুলিপি
জেগে ওঠে হৃদয়ে আবেগ—
পাহাড়ের মতো ওই মেঘ
সঙ্গে ল’য়ে আসে
মাঝরাতে কিংবা শেষরাতের আকাশে
যখন তোমারে,
—মৃত সে পৃথিবী এক আজ রাতে ছেড়ে দিলো যারে;
ছেঁড়া-ছেঁড়া শাদা মেঘ ভয় পেয়ে গেছে সব চ’লে
তরাসে ছেলের মতো—আকাশে নক্ষত্র গেছে জ্ব’লে
অনেক সময়—
তারপর তুমি এলে, মাঠের শিয়রে—চাঁদ;
পৃথিবীতে আজ আর যা হবার নয়,
একদিন হয়েছে যা—তারপর হাতছাড়া হ’য়ে
হারায়ে ফুরায়ে গেছে—আজো তুমি তার স্বাদ ল’য়ে
আর-একবার তবু দাঁড়ায়েছো এসে!
নিড়োনো হয়েছে মাঠ পৃথিবীর চারদিকে,
শস্যের খেত চ’ষে-চ’ষেগেছে চাষা চ’লে;
তাদের মাটির গল্প—তাদের মাঠের গল্প সব শেষ হ’লে
অনেক তবুও থাকে বাকি—
তুমি জানো—এ-পৃথিবী আজ জানে তা কি!
রিকশাওয়ালা কবি, বইও বেরিয়েছে দুটো – ইমু ইমরান কায়েস
রিকশাওয়ালা কবি, বইও বেরিয়েছে দুটো!
ইমু ইমরান কায়েস
বনশ্রী যাবেন?
বনশ্রী তো চিনিনা চিনায়া নিয়েন,
নতুন জায়গা না গেলে আর চিনমু ক্যামনে।
খাঁটি কথা।
টিএসসির মোড় থেকে যখন রিকশা ঠিক করি
তখন অন্ধকার হয়ে গেছে ঢাকা শহর, বাড়ি ফেরার তাড়া,
তাই অচিন রিকশাওয়ানাই সই।
প্রত্যেক মোড়ে ডান-বান বলতে বলতে চলার পথের অবিন্যস্ত আলসেমি,
অহেতুক সব চিন্তা-ভাবনার বিলাসিতা কেটে যাবে, যাক।
রাতের ঢাকা এখন আর খুব নিরাপদ না
চার দেয়ালে ফেরা দরকার, ঘরে ফেরা দরকার।
শাহজানপুর এসে ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ি কি না। বললাম, পড়ি না।
ডাক্তারি করি, রিকশাওয়ালার ফের বিনীত জিজ্ঞাসা
দেশেই থাকবেন, না বিদেশ চইলা যাবেন?
বললাম, দেশেই থাকবো, অর্ধেক জীবন শেষ,
নতুন করে আর কই যাবো।
দেশের অবস্থা তো ভালো না,
মানুষজন ভালো না, শিক্ষা নাই, সচেতনতা নাই,
থাইকা কি করবেন তার গলায় আক্ষেপ এবার!
আমি এইবার বিস্মিত হলাম,
রিকশাওয়ালার গলায় এই ধরনের সূক্ষ রুচিশীল হাহাকার তো থাকার কথা নয়,
সামথিং ইজ নট রাইট।
সত্যিকার অর্থেই নড়েচড়ে বসলাম।
আলো অন্ধকারে কেবল ঘামে ভেলা পিঠটুকু দেখা যাচ্ছে তার। ওঠার সময় চেহারা খেয়ালই করিনি।
সত্তা শার্টে লেপ্টে থাকা পিঠ থেকে কোন অ্যাবনর্মাল কিছু উদ্ধার করা গেল না।
এই দেশের মেইন সমস্যা কী ভাই জানেন?
সমস্যা তো অনেক।
ঘুষ, দুই নম্বরি, বিচার না হওয়া, প্রভাবশালীদের যা ইচ্ছা তাই করা, ধর্ম ইউজ করে হাবিজাবি কাজ করা, একে তাকে রাজাকার, একে তাকে নাস্তিক বানানো, বাজে রাজনীতি, তার মতে কোনটা কে জানে।
তাই জবাব না দিয়ে আমিই জিজ্ঞেস করলাম, কী?
এবার ভদ্রলোকের উত্তর শুনে ভিমড়ি খেলাম-
"মেইন সমস্যা হচ্ছে কেউ বই পড়ে না।"
তাকে জিজ্ঞেস করলাম, "আপনি পড়েন?"
অত না, টুকটাক।
আমি আবার কবিতার বই একটু বেশি পড়ি।
বলেন কী।
বিস্ময়ের মাত্রা বেড়ে রিকশা থেকে পড়ে যাওয়ার যোগাড় হয় আমার।
কার কবিতার বই পড়েন?
ভদ্রলোক প্রবল মমতায় জানান,
তার পছন্দের কবি শক্তি চট্টোপধ্যায় আর ফরাসী কবি আর্তুর ব্যাবো।
খিলগাঁওয়ের গলিতে আকাশ ফুড়ে হঠাৎ একটা পাহাড় সম উঁচু জ্বিন এসে যদি পথ রোধ করে দাঁড়াতো তবু এতো চমকাতাম না। আর্তুর র্যাবো, শক্তি।
কি বিস্ময়! কি বিস্ময়।
ভজলোকের নাম শ্রিপান্থ শফিক।
আপনার অনুমান ঠিক আছে, শ্রিপাছ টুক বানানো।
বরিশালের একেবারে ভেতর থেকে উঠে আসা একটা মানুষকে ওইটুকু মেলোড্রামা করতে দেয়াই যায়।
ছাত্র খারাপ ছিলেন না।
এসএসসি পরীক্ষার পর কবিতার 'ভূতে ধরলো।
আরজ আলী মাতুব্বর, সক্রেটস, স্টিফেন হকিং, শক্তি, র্যাবো, গিয়ম এপোলোনিয়ার, হুমায়ুন আজাদ পড়ার পর তার মনে হল
জীবন এক আশ্চর্য গিফট।
স্কুল কলেজে পড়ে সেইটা নষ্ট করার কোন মানে হয় না।
তাই আর পড়েননি! কবিতা লেখেন নিয়মিত, দুইটা বইও বেরিয়েছে।
যে জীবন তিনি যাপন করেন, তার মতে এটা প্রথা বিরোধী জীবন। একটা সেন্স অফ ফ্রিডম তো আছে!
খারাপ কী?
বাসার কাছাকাছি এসে ভদ্রলোকের সাথে কফি খেলাম এক কাপ।
কফি খেতে খেতে মনে হল, আহা জীবন!
কেউ কি ভীষণ দুঃসাহস নিয়ে জন্মায়!
আর কেউ কি করুণভাবে মাথা নত করে মেনে নেয় জাগতিক সমস্ত হিসাব।
ভদ্রলোকের প্রতি বুক ভর্তি হিংসা নিয়ে বাড়ি ফিরলাম!
হঠাৎ দেখা কবিতা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
হঠাৎ দেখা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শান্তিনিকেতন, ২৪ জুন, ১৯৩৬