আমি, নিম্ন-মধ্যবিত্ত বলছি কবিতা – ফুয়াদ স্বনম


আমি, নিম্ন-মধ্যবিত্ত বলছি
ফুয়াদ স্বনম

আমার বেশ মনে আছে, 
বাবা খুব ভোরে বেড়ুতেন আর ফিরতেন 
সবার ঘুমাবার পর। 

না প্রতিদিনই নয়, 
এই ধরুন, মাসের দশ থেকে
একুশ-বাইশ তারিখ পর্যন্ত।

বাড়িওয়ালার সামনে পড়াটা এড়াতেই 
এই ভোর পাঁচটা থেকে
বারোটা পযর্ন্ত অফিস।

বাবা বেশ রাগী ছিলেন,
আমরা বাবাকে ভয়ে কিছু প্রশ্ন করতে 
পারতাম না। পারলে, নিশ্চয়ই জিজ্ঞেস করতাম,

"বাবা, তুমি রোজ অফিসের আগে, ছুটির পরে
সংসদ ভবনের পামট্রিগুলোর নীচে অন্ধকার
স্যাঁতস্যাঁতে রাস্তায় বসে মাথা হেঁট করে কি ভাবো?

কে তোমায় সকালের নাস্তা বানিয়ে দেয়? 
লাঞ্চ করো কি কখনো?"

বাড়ি ভাড়া দেবার তারিখ উত্তীর্ণ হলেই, 
আমরা দু'ভাই গিয়ে দাঁড়াতাম
বাড়িওয়ালার সামনে করুণ মুখ করে, 
উনি গলে যেতেন।

এই হঠাৎ করুণ মুখ করার ব্যাপারটা
আমরা বেশ ভালোই রপ্ত করে ফেলেছিলাম। 

মোটরবাইক পাশ কেটে বের হলেই
আমি হা করে চেয়ে থাকতাম।

একদিন বাবা বলেছিলেন,
"শুনো আব্বা, নিম্ন মধ্যবিত্তদের স্বপ্ন দেখবারও একটা 
লিমিট থাকে রে বোকা।"

জবাবে বাবা কে সেদিন চমকে দিয়ে বলেছিলাম,
"বাবা, জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলির অপূরণের
আক্ষেপ থেকে জন্ম নেয়া সুপ্ত বাসনাগুলি

যদি হঠাৎই ঘুম ভেঙে লাফ দিয়ে জেগে উঠে
হাত ধরাধরি করে হাঁটতে চায়?
সেও কি নিম্নমধ্যবিত্ত হিসেবে অন্যায়ের সামিল হবে? 
নাকি সে বিত্তশালী হয়ে উঠবার ধৃষ্টতা?"

বলেই ভাবলাম, কি যে সব ভুলভাল
বকে ফেললাম বাবার সামনে? 
বেশী বলে ফেললাম না তো?

আমি নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে, 
শিক্ষা, সততা আর আদর্শই যাদের একমাত্র সম্বল, 
তাদের অন্তত বাবার মুখের ওপর
এমন বাগ্মিতা মানায় না।

গলির মুখে তিন রাস্তার মোড়ে
কার্তিক বাবুর মুদির দোকান।
তোমাকে ভয়ে কোনদিন বলিনি বাবা,

ভীষণ হাস্যোজ্জ্বল লোকটির মুখ, আষাঢ়ের
আকাশের মতো গোমড়া হয়ে যেতো
আমাদের বাকির স্লিপ ধরা হাতগুলো দেখলেই। 
একটা লজেন্সও কোনদিনও চাইতে পারিনি
বাকির খাতার কারণে।

বাকিতে মৌলিক চাহিদা মেটাতে মেটাতে 
শৈশব যে কোথায় ছুটে পালিয়েছিল, 
তা টের পেতে পেতে,
তখন আমিও আরেক বাবা হয়ে উঠছি।

চাল-ময়দার ঠোঙাগুলোকে কেটে
সেলাই করে খাতা বানাতাম, 
বছর শেষে আবার তাদের বিক্রি করে 
নতুন ক্লাসের সেকেন্ডহ্যান্ড বই কেনা।
নতুন বই কেনার কথা তো
কস্মিনকালেও ভাবতে পারিনি।

আমিষবিহীন পেঁপে ভাজি, আলুর ঝোল, 
বেগুন ভর্তা খেয়ে খেয়ে কতো 
দিন-রাত পার করেছি,
অন্য কিছুর চড়া আঁচে আমাদের 
বাজারের ব্যাগ জ্বলে যেত সেসময়।
অন্য কিছুর সামর্থ্য ছিলো না বলে।
ঈদে পরবে কদাচিৎ জুটেছে ফার্মের মুরগী।

আমাদের পিঠাপিঠি দু-ভাইয়ের জন্য 
একটিই শখের জিন্সপ্যান্ট কিনতে পেরেছিলাম 
তিনশত টাকা খরচা করে। 
তাও, একমাসের একটি টিউশুনির বেতন দিয়ে। 
মা সেটা আলমারিতে তুলে তুলে রাখতেন। 
যদি কোথাও দাওয়াত পড়ত, 
আমরা ভাগ করে নিতাম কে গায়ে হলুদে
যাবে সেটা পরে, আর বরযাত্রী কে হবে? 
এমন কোনো অনুষ্ঠান ছিলো না যে, 
আমরা দু'ভাই একসাথে গিয়েছি।
উপহার কেনার সামর্থ্য কোনদিনই আমাদের ছিলো না।
তাই, আমরা শুধু বরযাত্রী বা গায়ে হলুদেই যেতাম।

আমি একজন নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান।
যাদের, কোনো চাহিদা থাকতে নেই।
আমাদের মা তবু খুব সুখী ছিলেন, 
কারণ ক্ষুধা লাগলেও, আমরা ভাতের মাড়
লবণ ছিটিয়ে খেতে পারতাম।
তখনও, মাছের কাঁটা বেছে খেতে শিখিনি। 
মা-ও সেকথা জানতেন,
দুষতেন দারিদ্রতাকে। 
আমি দিব্যি পটলের তরকারি দিয়ে
আয়েশ করে খেয়ে ওঠার ভান করাটা
শিখে নিয়েছিলাম।
স্কুলের টিফিনের জন্য
জেদ করেছি কিনা 
ঢের সন্দেহ আছে!
স্কুলের মাইনে দেবার সাত তারিখ পার হলেই 
ঝন্টু স্যার দাঁড় করিয়ে রাখতেন 
এক পিরিয়ড প্রতিদিন, 
জানলে বাবা যদি কষ্ট পায়! 
তাই বলা হয়নি সেকথা কোনদিনই। 
প্রায়ই হাঁটু ছিলে দগদগে ক্ষত নিয়ে
ফিরতাম ফুটবল খেলে।
গভীর রাতে আমরা ঘুমিয়ে পড়লে, বাবা এসে
কেরোসিন লাগিয়ে দিতেন আন্টিসেপটিক হিসেবে। 
ঝরঝর করে পানি পড়তো
তখন তার চোখ বেয়ে। 
কেন বাবা! কেন ফেলতে? 
আমার হাঁটুর ক্ষত, এই যে রক্তাক্ত চামড়া ছেঁড়া,
কেন যে তার চোখের পুকুরটাকে
আন্দোলিত করে যেত, সে সময় বুঝতে পারিনি।

অন্যদের দেয়া সেকেন্ড হ্যান্ড জামাতেই
নিজেদের মানিয়ে নিতে শিখেছিলাম। 
তবে, আমাদের মাঝে ছিলো
পদ্ম পুকুরের মতো ভীষণ লজ্জা। 
কলেজে, ক্যাম্পাসে বা আত্মীয় স্বজনদের কাছে
আমাদের অবস্থান ছিলো সুদৃঢ় ও মর্যদা সম্পন্ন। 
বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় ছিলো না
আমাদের ভেতরের দৈন্যদশা।
কারণ, শিশুবেলা থেকেই
আমাদের দুটো শিক্ষা দেয়া হয়-
এক, আমরা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। 
আর দুই, আমরা সম্ভ্রান্ত পরিবারকে ধারণ করি।
আমাদের বুক, পেট, তল পেট, উদর,
বৃহদান্ত্র, ক্ষুদ্রান্ত্র সব ক্ষুধার তাড়নায়
ফেটে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলেও, 
আমাদের মুখে সবসময়
চাঁদের হাসি লেপ্টে থাকবে।
আমাদের মুখে সবসময়ই
চাঁদের হাসি লেপ্টে থাকতো।। 


আবৃত্তি

আবৃত্তি করেছেনঃ শামসউজজোহার

No comments: