নিশুর কাছে অলেখা চিঠি
ভাস্কর চৌধুরী
কিরে, আমাকে ক্ষমা করতে পেরেছিস ?
তোর সাথে যাই নি আমি নিশিমপুর ।
নিশিমপুরটা এখন কোথায় ?
জানিস তো, মাঝে মাঝে গাঁ গুলো বদলে যায় ।
আমার বয়েসটা দ্যাখ নিশু, সেটাও বদলে গেলো ।
সময়ের যেটুকু যায় সেতো ধারাপাতের নিয়মে ক্রমবর্তমান
সহজিয়ারা বলে, বয়েসটা আস্তে আস্তে কমে যায় ।
গোরখোদক আর জমি মাপকের ভেতর কোন তফাৎ দেখিস ?
নিজের কবর কেউ নিজে খুঁড়ে রাখে না ।
জমি মাপকও আপন জমি মাপে না ।
দলিল লেখক মুহূরীরা সাতচল্লিশের পর
ধীরে ধীরে জমিদার হলো ।
তোরা রেখে গেলি মাঠ, তারা সাফ কবলা লিখে নিলো ।
তোদের বসতটা আছে এখনও ।
তোর পিসির ছেলেটা সেখানে নাতিপুতি নিয়ে বাস করছে ।
এই তো জানতাম ।
কিছুদিন গানের দলে দূরের গাঁয়ে ছিলাম ।
গলায় মেডেল ঝুলিয়ে গাঁয়ে এসে দেখি তারা নেই ।
তোদের সেই পোদ্দার বাড়িটায় এখন হোসেন সাহেব ।
কি যে হয় রে, নিশু
মন পরানের গহীন বনে একটা হাহাকারের শব্দ পাই ।
সে হাহাকার আমার একার নয়
এ পাড়া থেকে যারা দেশবিভাগে চলে গেছে বহরমপুর আর মালদহে
তাদের কথা মনে পড়ে ।
শৈশবটা কৈশোরটা অন্যরকম নিশু ।
রাতে যখন একলা ঘরে, সব শব্দ থেমে যায়
একটা শব্দ তারস্বরে বুকের ভেতর কাপড় আছড়ায়
সে শব্দ আমাদের কৈশোরের প্রতিটি দিন
রাঙা মাসির বিয়ে আর তপন দাদার চিতার কাঠ
থরে থরে সেজে ওঠে, পাখিগুলো উড়ে যায়
চন্ডালটা চিতায় আগুনটা বাড়াতেই থাকে ।
যোগও আছে ।
বিয়োগটা বড় বুকে বাজে ।
সেই যে বিয়োগের কাল শুরু ।
আর থামে নি ।
ইস্কুলের হেড দফতরীটা কবরে গেলো ।
ইয়াকুব ।
নিশ্চয় তোর মনে পড়ে ।
তারপর একে একে সিংহ বাবু, বাগচী বাবু, ড্রিলের লক্ষী স্যার
সকলের চিতা সাজালাম ।
এখন রাতে বুকে ওঠে ও হরি নাম ।
চিতার আগুন ।
দেশটা চৌদ্দ গুষ্টি আর একশো বাপের ।
এখন দেখি এদেশে আমি ছাড়া তাদের কেউ বেঁচে নেই ।
বন্ধুরা কি আর আছে ?
বন্ধু বলতে নির্মল কুমোর
অশোক আর অক্ষয় ছুতার
তারাও এখন চলে গেছে মেয়ের সাথে ।
একাত্তরে আমি তো ওপারে যাই নি রে ।
যারা গেছিলো, তাদের ছেলে মেয়ে অনেকেই ওখানে থেকে গেছে ।
এখন সূতোয় টান পড়ছে ।
এখানকার চাকুরী শেষ ।
ওখানে মাটি কিনে চলে যাচ্ছে ।
ওখান থেকে ছেলেদের বিদেশ পাঠানো
আমেরিকা নয়
সৌদী বা কাতার দুবাই দেদার যাচ্ছে ।
নিশু, তুই বলতো নিশিমপুরে ক্যামন আছিস ?
ভালো থাকার কথা নয় রে
কৈশোর যে তোর এখানেই ।
টান পড়ে না ?
রাতে যখন একলা ঘরে ঘুমুতে যাস ?
তোর বৌ তো চলেই গেছে কবে
ছেলেরা ঘর পেতেছে ।
তোর ঘরে তুই একা থাকিস
শুনেছি তোর ঘরে একটা উঠোন আছে ।
ওখানে তো খেলিস নি আর
আমি দেখছি
কী দেখছি ?
আমি দেখছি পরিস্কার,
আমার বালককাল
কৈশোর যৌবন, গানের দল
একটা গানের খাতাও আছে রে আমার
দিনের বেলা বারান্দায় বসি
রাতের বেলা হঠাৎ শুনি আমার শরীর চিতার উপর
হরিবল দিচ্ছে সবে, বল রে হরি, বল হরিবল ।
হেথায় হরি হোথায় হরি
পার্থক্যটা কি তাহলে ?
পারবি নিশু, হিসেবটা মিলিয়ে দিতে ?
আবৃত্তি
আবৃত্তি করেছেনঃ তিতাস মাহমুদ
No comments:
Post a Comment