তোমার শঙ্খ ধুলায় প’ড়ে কবিতা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


তোমার শঙ্খ ধুলায় প’ড়ে
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.....বলাকা


তোমার শঙ্খ ধুলায় প’ড়ে,
     কেমন করে সইব।
বাতাস আলো গেল মরে
     এ কী রে দুর্দৈব।
লড়বি কে আয় ধ্বজা বেয়ে,
গান আছে যার ওঠ-না গেয়ে,
চলবি যারা চল্‌ রে ধেয়ে,
     আয় না রে নিঃশঙ্ক।
ধুলয় পড়ে রইল চেয়ে
     ওই যে অভয় শঙ্খ।

চলেছিলাম পূজার ঘরে
     সাজিয়ে ফুলের অর্ঘ্য।
খুঁজি সারাদিনের পরে
     কোথায় শান্তি-শর্গ।
এবার আমার হৃদয়-ক্ষত
ভেবেছিলাম হবে গত,
ধুয়ে মলিন চিহ্ন যত
     হব নিষ্কলঙ্ক।
পথে দেখি ধুলায় নত
     তোমার মহাশঙ্খ।

আরতি-দীপ এই কি জ্বালা।
     এই কি আমার সন্ধ্যা।
গাঁথার রক্তজবার মালা?
     হায় রজনীগন্ধা।
ভেবেছিলাম যোঝাযুঝি
মিটিয়ে পাব বিরাম খুঁজি,
চুকিয়ে দিয়ে ঋণের পুঁজি,
     লব তোমার অঙ্ক।
হেনকালে ডাকল বুঝি
     নীরব তব শঙ্খ।

যৌবনেরি পরশমণি
     করাও তবে স্পর্শ।
দীপক-তানে উঠুক ধ্বনি
     দীপ্ত প্রাণের হর্ষ।
নিশার বক্ষ বিদায় করে
উদ্‌বোধনে গগন ভরে
অন্ধ দিকে দিগন্তরে
     জাগাও-না আতঙ্ক।
দুই হাতে আজ তুলব ধরে
     তোমার জয়শঙ্খ।

জানি জানি তন্দ্রা মম
     রইবে না আর চক্ষে।
জানি শ্রাবণধারা-সম
     বাণ বাজিয়ে বক্ষে।
কেউ বা ছুটে আসবে পাশে,
কাঁদবে বা কেউ দীর্ঘশ্বাসে,
দুঃস্বপনে কাঁপবে ত্রাসে
     সুপ্তির পর্যঙ্ক।
বাজবে যে আজ মহোল্লাসে
     তোমার মহাশঙ্খ।

তোমার কাছে আরাম চেয়ে
     পেলাম শুধু লজ্জা।
এবার সকল অঙ্গ ছেয়ে
     পরাও রণসজ্জা।
ব্যাঘাত আসুক নব নব,
আঘাত খেয়ে অটল রব,
বক্ষে আমার দুঃখে তব
     বাজবে জয়ডঙ্ক।
দেব সকল শক্তি, লব
     অভয় তব শঙ্খ।

                                                                          রামগড়, ১২ জ্যৈষ্ঠ, ১৩২১


উৎসর্গ কবিতা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


উৎসর্গ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.....বলাকা


উইলি পিয়র্‌সন্‌ বন্ধুবরেষু
আপনারে তুমি সহজে ভুলিয়া থাক,
আমরা তোমারে ভুলিতে পারি না তাই।
সবার পিছনে নিজের গোপনে রাখ,
আমরা তোমারে প্রকাশ করিতে চাই।
ছোটোরে কখনো ছোট নাহি কর মনে,
আদর করিতে জান অনাদৃত জনে,
প্রীতি তব কিছু না চাহে নিজের জন্য,
তোমারে আদরি আপনারে করি ধন্য।


                                                                                            স্নেহাসক্ত
                                                                               শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

                                            ৭ মে ১৯১৬, তোসা-মারু জাহাজ, বঙ্গসাগর।


হে বিরাট নদী কবিতা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


হে বিরাট নদী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.....বলাকা


হে বিরাট নদী,
অদৃশ্য নিঃশব্দ তব জল
অবিচ্ছিন্ন অবিরল
চলে নিরবধি।
স্পন্দনে শিহরে শূন্য তব রুদ্র কায়াহীন বেগে;
বস্তুহীন প্রবাহের প্রচণ্ড আঘাত লেগে
পুঞ্জ পুঞ্জ বস্তুফেনা উঠে জেগে;
ক্রন্দসী কাঁদিয়া ওঠে বহ্নিভরা মেঘে।
আলোকের তীব্রচ্ছটা বিচ্ছুরিয়া উঠে বর্ণস্রোতে
ধাবমান অন্ধকার হতে;
ঘুর্ণাচক্রে ঘুরে ঘুরে মরে
                  স্তরে স্তরে
          সুর্যচন্দ্রতারা যত
          বুদ্‌বুদের মতো।
 
হে ভৈরবী, ওগো বৈরাগিণী,
চলেছ যে নিরুদ্দেশ সেই চলা তোমার রাগিণী,
          শব্দহীন সুর।
          অন্তহীন দূর
তোমারে কি নিরন্তর দেয় সাড়া।
সর্বনাশা প্রেমে তার নিত্য তাই তুমি ঘরছাড়া।
          উন্মত্ত সে-অভিসারে
          তব বক্ষোহারে
ঘন ঘন লাগে দোলা–ছড়ায় অমনি
          নক্ষত্রের  মণি;
আঁধারিয়া ওড়ে শূন্যে ঝোড়ো এলোচুল;
দুলে উঠে বিদ্যুতের দুল;
          অঞ্চল আকুল
          গড়ায় কম্পিত তৃণে,
চঞ্চল পল্লবপুঞ্জে বিপিনে বিপিনে;
বারম্বার ঝরে ঝরে পড়ে ফুল
জুঁই চাঁপা বকুল পারুল
          পথে পথে
তোমার ঋতুর থালি হতে।
শুধু ধাও, শুধু ধাও, শুধু বেগে ধাও
          উদ্দাম উধাও;
          ফিরে নাহি চাও,
যা কিছু তোমার সব দুই হাতে ফেলে ফেলে যাও।
কুড়ায়ে লও না কিছু, কর না সঞ্চয়;
নাই শোক, নাই ভয়,
পথের আনন্দবেগে অবাধে পাথেয় করো ক্ষয়।
 
যে মুহূর্তে পূর্ণ তুমি সে মুহূর্তে কিছু তব নাই,
          তুমি তাই
          পবিত্র সদাই।
তোমার চরণস্পর্শে বিশ্বধূলি
মলিনতা যায় ভুলি
          পলকে পলকে–
মৃত্যু ওঠে প্রাণ হয়ে ঝলকে ঝলকে।
যদি তুমি মুহূর্তের তরে
          ক্লান্তিভরে
          দাঁড়াও থমকি,
          তখনি চমকি
উচ্ছ্রিয়া উঠিবে বিশ্ব পুঞ্জ পুঞ্জ বস্তুর পর্বতে;
পঙ্গু মুক কবন্ধ বধির আঁধা
স্থুলতনু ভয়ংকরী বাধা
সবারে ঠেকায়ে দিয়ে দাঁড়াইবে পথে;
অণুতম পরমাণু আপনার ভারে
সঞ্চয়ের অচল বিকারে
বিদ্ধ হবে আকাশের মর্মমূলে
কলুষের বেদনার শূলে।
ওগো নটী, চঞ্চল অপ্সরী,
          অলক্ষ্য সুন্দরী
তব নৃত্যমন্দাকিনী নিত্য ঝরি ঝরি
          তুলিতেছে শুচি করি
          মৃত্যস্নানে বিশ্বের জীবন।
নিঃশেষে নির্মল নীলে বিকাশিছে নিখিল গগন।
 
ওরে কবি, তোরে আজ করেছে উতলা
ঝংকারমুখরা এই ভুবনমেখলা,
অলক্ষিত চরণের অকারণ অবারণ চলা।
নাড়ীতে নাড়ীতে তোর চঞ্চলের শুনি পদধ্বনি,
          বক্ষ তোর উঠে রনরনি।
নাহি জানে কেউ
রক্তে তোর নাচে আজি সমুদ্রের ঢেউ,
কাঁপে আজি অরণ্যের ব্যাকুলতা;
মনে আজি পড়ে সেই কথা–
যুগে যুগে এসেছি চলিয়া,
          স্খলিয়া স্খলিয়া
          চুপে চুপে
রূপ হতে রূপে
প্রাণ হতে প্রাণে।
নিশীথে প্রভাতে
যা কিছু পেয়েছি হাতে
এসেছি করিয়া ক্ষয় দান হতে দানে,
          গান হতে গানে।
 
ওরে দেখ্‌ সেই স্রোত হয়েছে মুখর,
তরণী কাঁপিছে থরথর।
তীরের সঞ্চয় তোর পড়ে থাক্‌ তীরে,
          তাকাস নে ফিরে।
সম্মুখের বাণী
          নিক তোরে টানি
          মহাস্রোতে
পশ্চাতের কোলাহল হতে
অতল আঁধারে — অকূল আলোতে।

                                                                                   এলাহাবাদ, ৩ পৌষ, ১৩২১

কাউকে ভালোবেসেছিলাম কবিতা – জীবনানন্দ দাশ


কাউকে ভালোবেসেছিলাম
জীবনানন্দ দাশ


কাউকে ভালোবেসেছিলাম জানি
তবুও ভালোবাসা,
দুপুরবেলার সূর্যে ভোরের শিশির
নেমে আসা,
ভোরের দিকে হৃদয় ফেরাই
যাই চলে যাই-
নীল সকালে যাই চলে যাই-
একটি নদী একটি অরূণ
শিউলি শিশির পাখি-
‘আমরা মায়ার মনের জিনিস
মায়াবিনীর বেলায় শুধু জাগি’
বলছে সে কোন্‌ ত্রিকোণ থেকে
ছায়ার পরিভাষা।
কাউকে ভালোবেসেছিলাম, জানি,
তবুও ভালোবাসা।
সে কোন্‌ সুদূর মরুর মনে চলে গেছ
হায়, যাযাবর তুমি,
সেইখানে কি মিলবে বনহংসী বাঁধা বাসা!

হায় বলিভূক, কখন ভেবেছিলে
মাটি ছেড়ে দূর আকাশের নীলে
ধূসর ডানার অগ্নি ছেড়ে দিলে
মিটে যাবে মায়াময়ী মাটির পিপাসা।


মৃত্যুর আগে কবিতা – জীবনানন্দ দাশ


মৃত্যুর আগে
জীবনানন্দ দাশ.....ধূসর পাণ্ডুলিপি


আমরা হেঁটেছি যারা নির্জন খড়ের মাঠে পউষ সন্ধ্যায়,
দেখেছি মাঠের পারে নরম নদীর নারী ছড়াতেছে ফুল
কুয়াশার; কবেকার পাড়াগাঁর মেয়েদের মতো যেন হায়
তারা সব; আমরা দেখেছি যারা অন্ধকারে আকন্দ ধুন্দুল
জোনাকিতে ভ’রে গেছে; যে-মাঠে ফসল নাই তাহার শিয়রে
চুপে দাঁড়ায়েছে চাঁদ–কোনো সাধ নাই তার ফসলের তরে;

আমরা বেসেছি যারা অন্ধকারে দীর্ঘ শীত রাত্রিটিরে ভালো,
খড়ের চালের পরে শুনিয়াছি মুগ্ধরাতে ডানার সঞ্চার:
পুরোনো পেঁচার ঘ্রাণ; অন্ধকারে আবার সে কোথায় হারালো!
বুঝেছি শীতের রাত অপরূপ, মাঠে-মাঠে ডানা ভাসাবার
গভীর আহ্লাদে ভরা; অশথের ডালে-ডালে ডাকিয়াছে বক;
আমরা বুঝেছি যারা জীবনের এই সব নিভৃত কুহক;

আমরা দেখেছি যারা বুনোহাঁস শিকারীর গুলির আঘাত
এড়ায়ে উড়িয়া যায় দিগন্তের নম্র নীল জ্যোৎস্নার ভিতরে,
আমরা রেখেছি যারা ভালোবেসে ধানের গুচ্ছের ’পরে হাত,
সন্ধ্যার কাকের মতো আকাঙ্ক্ষায় আমরা ফিরেছি যারা ঘরে;
শিশুর মুখের গন্ধ, ঘাস, রোদ, মাছরাঙা, নক্ষত্র, আকাশ
আমরা পেযেছি যারা ঘুরে ফিরে ইহাদের চিহ্ন বারোমাস;

দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রাণের অন্ধকারে হয়েছে হলুদ,
হিজলের জানালায় আলো আর বুলবুলি করিয়াছে খেলা,
ইঁদুর শীতের রাতে রেশমের মতো রোমে মাখিয়াছে খুদ,
চালের ধূসর গন্ধে তরঙ্গেরা রূপ হ’য়ে ঝরেছে দু-বেলা
নির্জন মাছের চোখে; পুকুরের পারে হাঁস সন্ধ্যার আঁধারে
পেয়েছে ঘুমের ঘ্রাণ–মেয়েলি হাতের স্পর্শ ল’যে গেছে তারে;
মিনারের মতো মেঘ সোনালি চিলেরে তার জানালায় ডাকে,
বেতের লতার নিচে চড়ুয়ের ডিম যেন নীল হ‘য়ে আছে,
নরম জলের গন্ধ দিয়ে নদী বার বার তীরটিরে মাখে,
খড়ের চালের ছায়া গাঢ় রাতে জ্যোৎস্নার উঠানে পড়িয়াছে;
বাতাসে ঝিঁঝির গন্ধ—বৈশাখের প্রান্তরের সবুজ বাতাসে;
নীলাভ নোনার বুকে ঘন রস গাঢ় আকাঙ্ক্ষায় নেমে আসে;

আমরা দেখেছি যারা নিবিড় বটের নিচে লাল-লাল ফল
পড়ে আছে; নির্জন মাঠের ভিড় মুখ দেখে নদীর ভিতরে;
যত নীল আকাশেরা র’য়ে গেছে খুঁজে ফেরে আরো নীল আকাশের তল;
পথে-পথে দেখিয়াছি মৃদু চোখ ছায়া ফেলে পৃথিবীর ’পরে;
আমরা দেখেছি যারা শুপুরীর সারি বেয়ে সন্ধ্যা আসে রোজ,
প্রতিদিন ভোর আসে ধানের গুচ্ছের মতে সবুজ সহজ;

আমরা বুঝেছি যারা বহুদিন মাস ঋতু শেষ হ’লে পর
পৃথিবীর সেই কন্যা কাছে এসে অন্ধকারে নদীদের কথা
ক’য়ে গেছে; আমরা বুঝেছি যারা পথ ঘাট মাঠের ভিতর
আরো-এক আলো আছে: দেহে তার বিকালবেলার ধূসরতা;
চোখের-দেখার হাত ছেড়ে দিয়ে সেই আলো হ’য়ে আছে স্থির:
পৃথিবীর কঙ্কাবতী ভেসে গিয়ে সেইখানে পায় ম্লান ধূপের শরীর;

আমরা মৃত্যুর আগে কি বুঝিতে চাই আর? জানি না কি আহা,
সব রাঙা কামনার শিয়রে যে দেয়ালের মতো এসে জাগে
ধূসর মৃত্যুর মুখ; একদিন পৃথিবীতে স্বপ্ন ছিলো—সোনা ছিলো যাহা
নিরুত্তর শান্তি পায়; যেন কোন্ মায়াবীর প্রয়োজনে লাগে।
কি বুঝিতে চাই আর? . . . রৌদ্র নিভে গেলে পাখি পাখালির ডাক
শুনিনি কি? প্রান্তরের কুয়াশায় দেখিনি কি উড়ে গেছে কাক!


বোধ কবিতা – জীবনানন্দ দাশ


বোধ
জীবনানন্দ দাশ.....ধূসর পাণ্ডুলিপি


আলো-অন্ধকারে যাই—মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়, কোন্ এক বোধ কাজ করে;
স্বপ্ন নয়—শান্তি নয়—ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়;
আমি তারে পারি না এড়াতে,
সে আমার হাত রাখে হাতে,
সব কাজ তুচ্ছ হয়—পণ্ড মনে হয়,
সব চিন্তা—প্রার্থনার সকল সময়
শূন্য মনে হয়,
শূন্য মনে হয়।

সহজ লোকের মতো কে চলিতে পারে।
কে থামিতে পারে এই আলোয় আঁধারে
সহজ লোকের মতো; তাদের মতন ভাষা কথা
কে বলিতে পারে আর; কোনো নিশ্চয়তা
কে জানিতে পারে আর? শরীরের স্বাদ
কে বুঝিতে চায় আর? প্রাণের আহ্লাদ
সকল লোকের মতো কে পাবে আবার।
সকল লোকের মতো বীজ বুনে আর
স্বাদ কই, ফসলের আকাঙ্ক্ষায় থেকে,
শরীরে মাটির গন্ধ মেখে,
শরীরে জলের গন্ধ মেখে,
উৎসাহে আলোর দিকে চেয়ে
চাষার মতন প্রাণ পেয়ে
কে আর রহিবে জেগে পৃথিবীর ’পরে?
স্বপ্ন নয়—শান্তি নয়—কোন্ এক বোধ কাজ করে
মাথার ভিতরে।
পথে চ’লে পারে—পারাপারে
উপেক্ষা করিতে চাই তারে;
মড়ার খুলির মতো ধ’রে
আছাড় মারিতে চাই, জীবন্ত মাথার মতো ঘোরে
তবু সে মাথার চারিপাশে,
তবু সে চোখের চারিপাশে,
তবু সে বুকের চারিপাশে;
আমি চলি, সাথে-সাথে সেও চ’লে আসে।

আমি থামি—
সেও থেমে যায়;

সকল লোকের মাঝে ব’সে
আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা?
আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
আমার পথেই শুধু বাধা?

জন্মিয়াছে যারা এই পৃথিবীতে
সন্তানের মতো হ’য়ে—
সন্তানের জন্ম দিতে-দিতে
যাহাদের কেটে গেছে অনেক সময়,
কিংবা আজ সন্তানের জন্ম দিতে হয়
যাহাদের; কিংবা যারা পৃথিবীর বীজখেতে আসিতেছে চ’লে
জন্ম দেবে—জন্ম দেবে ব’লে;
তাদের হৃদয় আর মাথার মতন
আমার হৃদয় না কি? তাহদের মন
আমার মনের মতো না কি?
—তবু কেন এমন একাকী?
তবু আমি এমন একাকী।
হাতে তুলে দেখিনি কি চাষার লাঙল?
বাল্‌টিতে টানিনি কি জল?
কাস্তে হাতে কতোবার যাইনি কি মাঠে?
মেছোদের মতো আমি কতো নদী ঘাটে
ঘুরিয়াছি;
পুকুরের পানা শ্যালা—আঁশ্‌টে গায়ের ঘ্রাণ গায়ে
গিয়েছে জড়ায়ে;
–এই সব স্বাদ;
—এ-সব পেয়েছি আমি, বাতাসের মতন অবাধ
বয়েছে জীবন,
নক্ষত্রের তলে শুয়ে ঘুমায়েছে মন
এক দিন;
এই সব সাধ
জানিয়াছি একদিন—অবাধ—অগাধ;
চ’লে গেছি ইহাদের ছেড়ে;
ভালোবেসে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে,
অবহেলা ক’রে আমি দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে,
ঘৃণা ক’রে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে;

আমারে সে ভালোবাসিয়াছে,
আসিয়াছে কাছে,
উপেক্ষা সে করেছে আমারে,
ঘৃণা ক’রে চ’লে গেছে—যখন ডেকেছি বারে-বারে
ভালোবেসে তারে;
তবুও সাধনা ছিলো একদিন–এই ভালোবাসা;
আমি তার উপেক্ষার ভাষা
আমি তার ঘৃণার আক্রোশ
অবহেলা ক’রে গেছি; যে-নক্ষত্র—নক্ষত্রের দোষ
আমার প্রেমের পথে বার-বার দিয়ে গেছে বাধা
আমি তা’ ভুলিয়া গেছি;
তবু এই ভালোবাসা—ধুলো আর কাদা।

মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়—প্রেম নয়—কোনো এক বোধ কাজ করে।
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চ’লে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে:
সে কেন জলের মতো ঘুরে-ঘুরে একা কথা কয়!
অবসাদ নাই তার? নাই তার শান্তির সময়?
কোনোদিন ঘুমাবে না? ধীরে শুয়ে থাকিবার স্বাদ
পাবে না কি? পাবে না আহ্লাদ
মানুষের মুখ দেখে কোনোদিন!
মানুষীর মুখ দেখে কোনোদিন!
শিশুদের মুখ দেখে কোনোদিন!

এই বোধ—শুধু এই স্বাদ
পায় সে কি অগাধ—অগাধ!
পৃথিবীর পথ ছেড়ে আকাশের নক্ষত্রের পথ
চায় না সে? করেছে শপথ
দেখিবে সে মানুষের মুখ?
দেখিবে সে মানুষীর মুখ?
দেখিবে সে শিশুদের মুখ?
চোখে কালো শিরার অসুখ,
কানে যেই বধিরতা আছে,
যেই কুঁজ—গলগণ্ড মাংসে ফলিয়াছে
নষ্ট শসা—পচা চাল্‌কুমড়ার ছাঁচে,
যে-সব হৃদয়ে ফলিয়াছে
—সেই সব।


সুচেতনা কবিতা – জীবনানন্দ দাশ


সুচেতনা
জীবনানন্দ দাশ.....বনলতা সেন


সুচেতনা, তুমি এক দূরতর দ্বীপ
বিকেলের নক্ষত্রের কাছে;
সেইখানে দারুচিনি-বনানীর ফাঁকে
নির্জনতা আছে।
এই পৃথিবীর রণ রক্ত সফলতা
সত্য; তবু শেষ সত্য নয়।
কলকাতা একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে;
তবুও তোমার কাছে আমার হৃদয়।

আজকে অনেক রূঢ় রৌদ্রে ঘুরে প্রাণ
পৃথিবীর মানুষকে মানুষের মতো
ভালোবাসা দিতে গিয়ে তবু
দেখেছি আমারি হাতে হয়তো নিহত
ভাই বোন বন্ধু পরিজন প’ড়ে আছে;
পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন;
মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীরই কাছে।

কেবলি জাহাজ এসে আমাদের বন্দরের রোদে
দেখেছি ফসল নিয়ে উপনীত হয়;
সেই শস্য অগণন মানুষের শব;
শব থেকে উৎসারিত স্বর্ণের বিস্ময়
আমাদের পিতা বুদ্ধ কনফুশিয়সের মতো আমাদেরো প্রাণ
মূক ক’রে রাখে; তবু চারিদিকে রক্তক্লান্ত কাজের আহ্বান।

সুচেতনা, এই পথে আলো জ্বেলে— এ-পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে;
সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ;
এ-বাতাস কি পরম সূর্যকরোজ্জ্বল;
প্রায় তত দূর ভালো মানব-সমাজ
আমাদের মতো ক্লান্ত ক্লান্তিহীন নাবিকের হাতে
গ’ড়ে দেবো, আজ নয়, ঢের দূর অন্তিম প্রভাতে।

মাটি-পৃথিবীর টানে মানবজন্মের ঘরে কখন এসেছি,
না এলেই ভালো হ’তো অনুভব ক’রে;
এসে যে গভীরতর লাভ হ’লো সে-সব বুঝেছি
শিশির শরীর ছুঁয়ে সমুজ্জ্বল ভোরে;
দেখেছি যা হ’লো হবে মানুষের যা হবার নয়
—শাশ্বত রাত্রির বুকে সকলি অনন্ত সূর্যোদয়।


বনলতা সেন কবিতা – জীবনানন্দ দাশ


বনলতা সেন
জীবনানন্দ দাশ.....বনলতা সেন


হাজার বছর ধ’রে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন।

চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের’ পর
হাল ভেঙে যে-নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।

সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রং নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে— সব নদী— ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।

ধান কাটা হ’য়ে গেছে কবিতা – জীবনানন্দ দাশ


ধান কাটা হ’য়ে গেছে
জীবনানন্দ দাশ.....বনলতা সেন


ধান কাটা হ’য়ে গেছে কবে যেন— খেতে মাঠে প’ড়ে আছে খড়
পাতা কুটো ভাঙা ডিম— সাপের খোলস নীড় শীত।
এই সব উৎরায়ে ওইখানে মাঠের ভিতর
ঘুমাতেছে কয়েকটি পরিচিত লোক আজ— কেমন নিবিড়।

ওইখানে একজন শুয়ে আছে— দিনরাত দেখা হ’তো কতো কতো দিন,
হৃদয়ের খেলা নিয়ে তার কাছে করেছি যে কতো অপরাধ;
শান্তি তবু: গভীর সবুজ ঘাস ঘাসের ফড়িং
আজ ঢেকে আছে তার চিন্তা আর জিজ্ঞাসার অন্ধকার স্বাদ।

পথ হাঁটা কবিতা – জীবনানন্দ দাশ


পথ হাঁটা
জীবনানন্দ দাশ.....বনলতা সেন


কি এক ইশারা যেন মনে রেখে এক-একা শহরের পথ থেকে পথে
অনেক হেঁটেছি আমি; অনেক দেখেছি আমি ট্রাম-বাস সব ঠিক চলে;
তারপর পথ ছেড়ে শান্ত হ’য়ে চ’লে যায় তাহাদের ঘুমের জগতে;

সারা রাত গ্যাসলাইট আপনার কাজ বুঝে ভালো ক’রে জ্বলে।
কেউ ভুল করেনাকো— ইঁট বাড়ি সাইনবোর্ড জানালা কপাট ছাদ সব
চুপ হ’য়ে ঘুমাবার প্রয়োজন বোধ করে আকাশের তলে।

এক-একা পথ হেঁটে এদের গভীর শান্তি হৃদয়ে করেছি অনুভব;
তখন অনেক রাত— তখন অনেক তারা মনুমেণ্ট মিনারের মাথা
নির্জনে ঘিরেছে এসে; মনে হয় কোনোদিন এর চেয়ে সহজ সম্ভব

আর-কিছু দেখেছি কি: একরাশ তারা-আর-মনুমেণ্ট-ভরা কলকাতা?
চোখ নিচে নেমে যায়— চুরুট নীরবে জ্বলে— বাতাসে অনেক ধুলো খড়;
চোখ বুজে একপাশে স’রে যাই— গাছ থেকে অনেক বাদামী জীর্ণ পাতা

উড়ে গেছে; বেবিলনে এক-একা এমনই হেঁটেছি আমি রাতের ভিতর
কেন যেন; আজো আমি জানিনাকো হাজার-হাজার ব্যস্ত বছরের পর।


আমাকে তুমি কবিতা – জীবনানন্দ দাশ


আমাকে তুমি
জীবনানন্দ দাশ.....বনলতা সেন


আমাকে
তুমি দেখিয়েছিলে একদিন;
মস্ত বড়ো ময়দান— দেবদারু পামের নিবিড় মাথা— মাইলের পর মাইল;
দুপুরবেলার জনবিরল গভীর বাতাস
দূর শূন্যে চিলের পাটকিলে ডানার ভিতর অস্পষ্ট হ’য়ে হারিয়ে যায়;
জোয়ারের মতো ফিরে আসে আবার;
জানালায়-জানালায় অনেকক্ষণ ধ’রে কথা বলে;
পৃথিবীকে মায়াবীর নদীর পারের দেশ ব’লে মনে হয়।
তারপর
দূরে
অনেক দূরে
খররৌদ্রে পা ছড়িয়ে বর্ষীয়সী রূপসীর মতো ধান ভানে— গান গায়— গান গায়
এই দুপুরের বাতাস।

এক-একটা দুপুরে এক-একটা পরিপূর্ণ জীবন অতিবাহিত হ’য়ে যায় যেন।

বিকেলে নরম মুহূর্ত;
নদীর জলের ভিতর শম্বর, নীলগাই, হরিণের ছায়ার আসা-যাওয়া;
একটা ধবল চিতল-হরিণীর ছায়া
আতার ধূসর ক্ষীরে-গড়া মূর্তির মতো
নদীর জলেসমস্ত বিকেলবেলা ধ’রে
স্থির।

মাঝে-মাঝে অনেক দূর থেকে শ্মশানের চন্দনকাঠের চিতার
গন্ধ,
আগুনের— ঘিয়ের ঘ্রাণ;
বিকেলে
অসম্ভব বিষণ্ণতা।
ঝাউ হরিতকী শাল, নিভন্ত সূর্যে
পিয়াশাল পিয়াল আমলকী দেবদারু—
বাতাসের বুকে স্পৃহা, উৎসাহ, জীবনের ফেনা;

শাদা শাদাছিট কালো পায়রার ওড়াউড়ি জ্যোৎস্নায়—
ছায়ায়,
রাত্রি;
নক্ষত্র ও নক্ষত্রের
অতীত নিস্তব্ধতা।

মরণের পরপারে বড়ো অন্ধকার
এই সব আলো প্রেম ও নির্জনতার মতো।


অন্ধকার কবিতা – জীবনানন্দ দাশ


অন্ধকার
জীবনানন্দ দাশ.....বনলতা সেন


গভীর অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দে
জেগে উঠলাম আবার;

তাকিয়ে দেখলাম পাণ্ডুর চাঁদ বৈতরণীর থেকে তার
অর্ধেক ছায়া
গুটিয়ে নিয়েছে যেন
কীর্তিনাশার দিকে।

ধানসিড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়েছিলাম— পউষের রাতে—
কোনোদিন আর জাগবো না জেনে
কোনোদিন জাগবো না আমি— কোনোদিন জাগবো না আর—

হে নীল কস্তুরী আভার চাঁদ,
তুমি দিনের আলো নও, উদ্যম নও, স্বপ্ন নও,
হৃদয়ে যে মৃত্যুর শান্তি ও স্থিরতা রয়েছে
রয়েছে যে অগাধ ঘুম
সে-আস্বাদ নষ্ট করবার মতো শেলতীব্রতা তোমার নেই,
তুমি প্রদাহ প্রবহমান যন্ত্রণা নও—জানো না কি চাঁদ,
নীল কস্তুরী আভার চাঁদ,
জানো না কি নিশীথ,
আমি অনেক দিন— অনেক অনেক দিন
অন্ধকারের সারাৎসারে অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে থেকে
হঠাৎ ভোরের আলোর মূর্খ উচ্ছ্বাসে নিজেকে পৃথিবীর জীব ব’লেবুঝতে পেরেছি আবার;
ভয় পেয়েছি,
পেয়েছি অসীম দুর্নিবার বেদনা;
দেখেছি রক্তিম আকাশে সূর্য জেগে উঠে
মানুষিক সৈনিক সেজে পৃথিবীর মুখোমুখি দাঁড়াবার জন্য
আমাকে নির্দেশ দিয়েছে;
আমার সমস্ত হৃদয় ঘৃণায়— বেদনায়— আক্রোশে ভ’রে গিয়েছে;
সূর্যের রৌদ্রে আক্রান্ত এই পৃথিবী যেন কোটি-কোটি শূয়োরের আর্তনাদে
উৎসব শুরু করেছে।
হায়, উৎসব!
হৃদয়ের অবিরল অন্ধকারের ভিতর সূর্যকে ডুবিয়ে ফেলে
আবার ঘুমোতে চেয়েছি আমি,
অন্ধকারের স্তনের ভিতর যোনির ভিতর অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে
থাকতে চেয়েছি।

হে নর, হে নারী,
তোমাদের পৃথিবীকে চিনিনি কোনোদিন;
আমি অন্য কোনো নক্ষত্রের জীব নই।
যেখানে স্পন্দন, সংঘর্ষ, গতি, যেখানে উদ্যম, চিন্তা, কাজ,
সেখানেই সূর্য, পৃথিবী, বৃহস্পতি, কালপুরুষ, অনন্ত আকাশগ্রন্থি,
শত-শত শূকরের চিৎকার সেখানে,শত-শত শূকরীর প্রসববেদনার আড়ম্বর;
এই সব ভয়াবহ আরতি!

গভীর অন্ধকারের ঘুমের আস্বাদে আমার আত্মা লালিত;
আমাকে কেন জাগাতে চাও?
হে সময়গ্রন্থি, হে সূর্য, হে মাঘনিশীথের কোকিল,
হে স্মৃতি, হে হিম হাওয়া,
আমাকে জাগাতে চাও কেন।।

অরব অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দে
জেগে উঠবো না আর;
তাকিলে দেখবো না নির্জন বিমিশ্র চাঁদ বৈতরণীর
থেকে
অর্ধেক ছায়া গুটিয়ে নিয়েছে
কীর্তিনাশার দিকে।
ধানসিড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়ে থাকবো— ধীরে— পউষের রাতে—
কোনোদিন জাগবো না জেনে—
কোনোদিন জাগবে না আমি— কোনোদিন আর।