শেষ চিঠি – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


শেষ চিঠি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


মনে হচ্ছে শূন্য বাড়িটা অপ্রসন্ন,
অপরাধ হয়েছে আমার
তাই আছে মুখ ফিরিয়ে।
ঘরে ঘরে বেড়াই ঘুরে,
আমার জায়গা নেই–
হাঁপিয়ে বেরিয়ে চলে আসি।
এ বাড়ি ভাড়া দিয়ে চলে যাব দেরাদুনে।
অমলির ঘরে ঢুকতে পারি নি বহুদিন
মোচড় যেন দিত বুকে।
ভাড়াটে আসবে, ঘর দিতেই হবে সাফ ক’রে,
তাই খুললেম ঘরের তালা।
একজোড়া আগ্রার জুতো,
চুল বাঁধবার চিরুনি, তেল, এসেন্সের শিশি
শেলফে তার পড়বার বই,
ছোটো হার্মোনিয়ম।
একটা অ্যালবাম,
ছবি কেটে কেটে জুড়েছে তার পাতায়।
আলনায় তোয়ালে, জামা, খদ্দরের শাড়ি।
ছোটো কাঁচের আলমারিতে নানা রকমের পুতুল,
শিশি, খালি পাউডারের কৌটো।
চুপ করে বসে রইলেম চৌকিতে।
টেবিলের সামনে।
লাল চামড়ার বাক্স,
ইস্কুলে নিয়ে যেত সঙ্গে।
তার থেকে খাতাটি নিলেম তুলে,
আঁক কষবার খাতা।
ভিতর থেকে পড়ল একটি আখোলা চিঠি,
আমারি ঠিকানা লেখা
অমলির কাঁচা হাতের অক্ষরে।
শুনেছি ডুবে মরবার সময়
অতীত কালের সব ছবি
এক মুহূর্তে দেখা দেয় নিবিড় হয়ে–
চিঠিখানি হাতে নিয়ে তেমনি পড়ল মনে
অনেক কথা এক নিমেষে।
অমলার মা যখন গেলেন মারা
তখন ওর বয়স ছিল সাত বছর।
কেমন একটা ভয় লাগল মনে,
ও বুঝি বাঁচবে না বেশি দিন।
কেননা বড়ো করুণ ছিল ওর মুখ,
যেন অকালবিচ্ছেদের ছায়া
ভাবীকাল থেকে উল্টে এসে পড়েছিল
ওর বড়ো বড়ো কালো চোখের উপরে।
সাহস হ’ত না ওকে সঙ্গছাড়া করি।
কাজ করছি আপিসে বসে,
হঠাৎ হ’ত মনে
যদি কোনো আপদ ঘটে থাকে।
বাঁকিপুর থেকে মাসি এল ছুটিতে–
বললে, “মেয়েটার পড়াশুনো হল মাটি।
মুর্খু মেয়ের বোঝা বইবে কে
আজকালকার দিনে।’
লজ্জা পেলেম কথা শুনে তার,
বললেম “কালই দেব ভর্তি করে বেথুনে’।
ইস্কুলে তো গেল,
কিন্তু ছুটির দিন বেড়ে যায় পড়ার দিনের চেয়ে।
কতদিন স্কুলের বাস্‌ অমনি যেত ফিরে।
সে চক্রান্তে বাপেরও ছিল যোগ।
ফিরে বছর মাসি এল ছুটিতে;
বললে, “এমন করে চলবে না।
নিজে ওকে যাব নিয়ে,
বোর্ডিঙে দেব বেনারসের স্কুলে,
ওকে বাঁচানো চাই বাপের স্নেহ থেকে।’
মাসির সঙ্গে গেল চলে।
অশ্রুহীন অভিমান
নিয়ে গেল বুক ভরে
যেতে দিলেম বলে।
বেরিয়ে পড়লেম বদ্রিনাথের তীর্থযাত্রায়
নিজের কাছ থেকে পালাবার ঝোঁকে।
চার মাস খবর নেই।
মনে হল গ্রন্থি হয়েছে আলগা
গুরুর কৃপায়।
মেয়েকে মনে মনে সঁপে দিলেম দেবতার হাতে,
বুকের থেকে নেমে গেল বোঝা।
চার মাস পরে এলেম ফিরে।
ছুটেছিলেম অমলিকে দেখতে কাশীতে–
পথের মধ্যে পেলেম চিঠি–
কী আর বলব,
দেবতাই তাকে নিয়েছে।
যাক সে-সব কথা।।
অমলার ঘরে বসে সেই আখোলা চিঠি খুলে দেখি,
তাতে লেখা–
“তোমাকে দেখতে বড্‌ডো ইচ্ছে করছে’।
আর কিছুই নেই।


নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে কবিতা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে
রয়েছ নয়নে নয়নে,
হৃদয় তোমারে পায় না জানিতে
হৃদয়ে রয়েছ গোপনে।

বাসনা বসে মন অবিরত,
ধায় দশ দিশে পাগলের মতো।
স্থির আঁখি তুমি ক্ষরণে শতত
জাগিছ শয়নে স্বপনে।

সবাই ছেড়েছে নাই যার কেহ
তুমি আছ তার আছে তব কেহ
নিরাশ্রয় জন পথ যার যেও
সেও আছে তব ভবনে।

তুমি ছাড়া কেহ সাথি নাই আর
সমুখে অনন্ত জীবন বিস্তার,
কাল পারাপার করিতেছ পার
কেহ নাহি জানে কেমনে।

জানি শুধু তুমি আছ তাই আছি
তুমি প্রাণময় তাই আমি বাঁচি,
যতো পাই তোমায় আরো ততো যাচি
যতো জানি ততো জানি নে।

জানি আমি তোমায় পাবো নিরন্তন
লোক লোকান্তরে যুগ যুগান্তর
তুমি আর আমি, মাঝে কেহ নাই
কোনো বাঁধা নাই ভুবনে।

নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে
রয়েছ নয়নে নয়নে।


আমরা চাষ করি আনন্দে কবিতা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


আমরা চাষ করি আনন্দে
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


আমরা চাষ করি আনন্দে।
মাঠে মাঠে বেলা কাটে সকাল হতে সন্ধে॥
রৌদ্র ওঠে, বৃষ্টি পড়ে, বাঁশের বনে পাতা নড়ে,
বাতাস ওঠে ভরে ভরে চষা মাটির গন্ধে॥
সবুজ প্রাণের গানের লেখা রেখায় রেখায় দেয় রে দেখা,
মাতে রে কোন্‌ তরুণ কবি নৃত্যদোদুল ছন্দে।
ধানের শিষে পুলক ছোটে– সকল ধরা হেসে ওঠে
অঘ্রানেরই সোনার রোদে, পূর্ণিমারই চন্দ্রে॥


অকর্মার বিভ্রাট কবিতা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


অকর্মার বিভ্রাট
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


লাঙল কাঁদিয়া বলে ছাড়ি দিয়ে গলা,
তুই কোথা হতে এলি ওরে ভাই ফলা?
যেদিন আমার সাথে তোরে দিল জুড়ি
সেই দিন হতে মোর মাথা-খোঁড়াখুঁড়ি।
ফলা কহে, ভালো ভাই, আমি যাই খ’সে,
দেখি তুমি কী আরামে থাক ঘরে ব’সে।
ফলাখানা টুটে গেল, হল্‌খানা তাই
খুশি হয়ে পড়ে থাকে, কোনো কর্ম নাই।
চাষা বলে, এ আপদ আর কেন রাখা,
এরে আজ চলা করে ধরাইব আখা।
হল্‌ বলে, ওরে ফলা, আয় ভাই ধেয়ে–
খাটুনি যে ভালো ছিল জ্বলুনির চেয়ে।


অন্তর মম বিকশিত করো কবিতা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


অন্তর মম বিকশিত করো
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


অন্তর মম বিকশিত করো
অন্তরতর হে।
নির্মল করো, উজ্জ্বল করো,
সুন্দর কর হে।
জাগ্রত করো, উদ্যত করো,
নির্ভয় করো হে।
মঙ্গল করো, নরলস নিঃসংশয় করো হে।
অন্তর মম বিকশিত করো,
অন্তরতর হে।

যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে,
মুক্ত করো হে বন্ধ,
সঞ্চার করো সকল মর্মে
শান্ত তোমার ছন্দ।
চরণপদ্মে মম চিত নিঃস্পন্দিত করো হে,
নন্দিত করো, নন্দিত করো,
নন্দিত করো হে।।
অন্তর মম বিকশিত করো
অন্তরতর হে।


আফ্রিকা কবিতা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


আফ্রিকা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


উদ্‌ভ্রান্ত সেই আদিম যুগে
স্রষ্টা যখন নিজের প্রতি অসন্তোষে
নতুন সৃষ্টিকে বারবার করছিলেন বিধ্বস্ত,
তাঁর সেই অধৈর্যে ঘন-ঘন মাথা নাড়ার দিনে
রুদ্র সমুদ্রের বাহু
প্রাচী ধরিত্রীর বুকের থেকে
ছিনিয়ে নিয়ে গেল তোমাকে, আফ্রিকা-
বাঁধলে তোমাকে বনস্পতির নিবিড় পাহারায়
কৃপণ আলোর অন্তঃপুরে।
সেখানে নিভৃত অবকাশে তুমি
সংগ্রহ করছিলে দুর্গমের রহস্য,
চিনছিলে জলস্থল-আকাশের দুর্বোধ সংকেত,
প্রকৃতির দৃষ্টি-অতীত জাদু
মন্ত্র জাগাচ্ছিল তোমার চেতনাতীত মনে।
বিদ্রূপ করছিলে ভীষণকে
বিরূপের ছদ্মবেশে,
শঙ্কাকে চাচ্ছিলে হার মানাতে
আপনাকে উগ্র করে বিভীষিকার প্রচণ্ড মহিমায়
তাণ্ডবের দুন্দুভিনিনাদে।।

হায় ছায়াবৃতা,
কালো ঘোমটার নীচে
অপরিচিত ছিল তোমার মানবরূপ
উপেক্ষার আবিল দৃষ্টিতে।
এল ওরা লোহার হাতকড়ি নিয়ে,
নখ যাদের তীক্ষ্ণ তোমার নেকড়ের চেয়ে,
এল মানুষ-ধরার দল
গর্বে যারা অন্ধ তোমার সূর্যহারা অরণ্যের চেয়ে।
সভ্যের বর্বর লোভ
নগ্ন করল আপন নির্লজ্জ অমানুষতা।
তোমার ভাষাহীন ক্রন্দনে বাষ্পাকুল অরণ্যপথে
পঙ্কিল হল ধূলি তোমার রক্তে অশ্রুতে মিশে,
দস্যু-পায়ের কাঁটা-মারা জুতোর তলা
য়বীভৎস কাদার পিণ্ড
চিরচিহ্ন দিয়ে গেল তোমার অপমানিত ইতিহাসে।।

সমুদ্রপারে সেই মুহূর্তেই তাদের পাড়ায় পাড়ায়
মন্দিরে বাজছিল পূজার ঘণ্টা
সকালে সন্ধ্যায়, দয়াময় দেবতার নামে;
শিশুরা খেলছিল মায়ের কোলে;
কবির সংগীতে বেজে উঠছিল
সুন্দরের আরাধনা।।

আজ যখন পশ্চিম দিগন্তে
প্রদোষকাল ঝঞ্ঝাবাতাসে রুদ্ধশ্বাস,
যখন গুপ্ত গহ্বর থেকে পশুরা বেরিয়ে এল-
অশুভ ধ্বনিতে ঘোষণা করল দিনের অন্তিমকাল,
এসো যুগান্তরের কবি,
আসন্ন সন্ধ্যার শেষ রশ্মিপাতে
দাঁড়াও ওই মানহারা মানবীর দ্বারে;
বলো ‘ক্ষমা কর’-
হিংস্র প্রলাপের মধ্যে
সেই হোক তোমার সভ্যতার শেষ পুণ্যবাণী।।


বিপদে মোরে রক্ষা করো কবিতা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


বিপদে মোরে রক্ষা করো
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.....গীতাঞ্জলি


বিপদে মোরে রক্ষা করো
এ নহে মোর প্রার্থনা,
বিপদে আমি না যেন করি ভয়।
দুঃখতাপে ব্যথিত চিতে
নাই বা দিলে সান্ত্বনা,
দুঃখে যেন করিতে পারি জয়।
সহায় মোর না যদি জুটে
নিজের বল না যেন টুটে,
সংসারেতে ঘটিলে ক্ষতি
লভিলে শুধু বঞ্চনা
নিজের মনে না যেন মানি ক্ষয়।

আমারে তুমি করিবে ত্রাণ
এ নহে মোর প্রার্থনা,
তরিতে পারি শকতি যেন রয়।
আমার ভার লাঘব করি
নাই বা দিলে সান্ত্বনা,
বহিতে পারি এমনি যেন হয়।
নম্রশিরে সুখের দিনে
তোমারি মুখ লইব চিনে,
দুখের রাতে নিখিল ধরা
যেদিন করে বঞ্চনা
তোমারে যেন না করি সংশয়।


দুই বিঘা জমি কবিতা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


দুই বিঘা জমি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


শুধু বিঘে-দুই ছিল মোর ভুঁই, আর সবই গেছে ঋণে।
বাবু বলিলেন, ‘বুঝেছ উপেন? এ জমি লইব কিনে।’
কহিলাম আমি, ‘তুমি ভূস্বামী, ভূমির অন্ত নাই –
চেয়ে দেখো মোর আছে বড়জোর মরিবার মতো ঠাঁই।
শুনি রাজা কহে, ‘বাপু, জানো তো হে, করেছি বাগানখানা,
পেলে দুই বিঘে প্রস্থে ও দিঘে সমান হইবে টানা –
ওটা দিতে হবে।’ কহিলাম তবে বক্ষে জুড়িয়া পাণি
সজল চক্ষে, ‘করুন রক্ষে গরিবের ভিটেখানি।
সপ্তপুরুষ যেথায় মানুষ সে মাটি সোনার বাড়া,
দৈন্যের দায়ে বেচিব সে মায়ে এমনি লক্ষ্মীছাড়া!’
আঁখি করি লাল রাজা ক্ষণকাল রহিল মৌনভাবে,
কহিলেন শেষে ক্রুর হাসি হেসে, ‘আচ্ছা, সে দেখা যাবে।’

পরে মাস-দেড়ে ভিটে মাটি ছেড়ে বাহির হইনু পথে –
করিল ডিক্রি, সকলই বিক্রি মিথ্যা দেনার খতে।
এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি,
রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।
মনে ভাবিলাম, মোরে ভগবান রাখিবে না মোহগর্তে,
তাই লিখি দিল বিশ্বনিখিল দু বিঘার পরিবর্তে।
সন্ন্যাসীবেশে ফিরি দেশে দেশে হইয়া সাধুর শিষ্য –
কত হেরিলাম মনোহর ধাম, কত মনোরম দৃশ্য।
ভূধরে সাগরে বিজনে নগরে যখন যেখানে ভ্রমি
তবু নিশিদিনে ভুলিতে পারি নে সেই দুই বিঘা জমি।
হাটে মাঠে বাটে এইমত কাটে বছর পনেরো-ষোলো,
একদিন শেষে ফিরিবারে দেশে বড়োই বাসনা হল।।

নমোনমো নম, সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি!
গঙ্গার তীর, স্নিগ্ধ সমীর জীবন জুড়ালে তুমি।
অবারিত মাঠ, গগনললাট চুমে তব পদধুলি –
ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় ছোটো ছোটো গ্রামগুলি।
পল্লবঘন আম্রকানন, রাখালের খেলাগেহ –
স্তব্ধ অতল দিঘি কালোজল নিশীথশীতলস্নেহ।
বুক-ভরা-মধু বঙ্গের বধু জল লয়ে যায় ঘরে
মা বলিতে প্রাণ করে আনচান, চোখে আসে জল ভরে।
দুই দিন পরে দ্বিতীয় প্রহরে প্রবেশিনু নিজগ্রামে –
কুমোরের বাড়ি দক্ষিণে ছাড়ি, রথতলা করি বামে,
রাখি হাটখোলা নন্দীর গোলা, মন্দির করি পাছে
তৃষাতুর শেষে পঁহুছিনু এসে আমার বাড়ির কাছে।।

ধিক্ ধিক্ ওরে, শত ধিক্ তোরে নিলাজ কুলটা ভূমি,
যখনি যাহার তখনি তাহার – এই কি জননী তুমি!
সে কি মনে হবে একদিন যবে ছিলে দরিদ্রমাতা
আঁচল ভরিয়া রাখিতে ধরিয়া ফলফুল শাক-পাতা!
আজ কোন্ রীতে কারে ভুলাইতে ধরেছ বিলাসবেশ –
পাঁচরঙা পাতা অঞ্চলে গাঁথা, পুষ্পে খচিত কেশ!
আমি তোর লাগি ফিরেছি বিবাগি গৃহহারা সুখহীন,
তুই হেথা বসি ওরে রাক্ষসী, হাসিয়া কাটাস দিন!
ধনীর আদরে গরব না ধরে! এতই হয়েছ ভিন্ন –
কোনোখানে লেশ নাহি অবশেষ সে দিনের কোনো চিহ্ন!
কল্যাণময়ী ছিলে তুমি অয়ী, ক্ষুধাহরা সুধারাশি।
যত হাসো আজ, যত করো সাজ, ছিলে দেবী – হলে দাসী।।

বিদীর্ণহিয়া ফিরিয়া ফিরিয়া চারি দিকে চেয়ে দেখি –
প্রাচীরের কাছে এখনো যে আছে সেই আমগাছ একি!
বসি তার তলে নয়নের জলে শান্ত হইল ব্যথা,
একে একে মনে উদিল স্মরণে বালককালের কথা।
সেই মনে পড়ে, জ্যৈষ্ঠের ঝড়ে রাত্রে নাহিকো ঘুম,
অতি ভোরে উঠি তাড়াতাড়ি ছুটি আম কুড়াবার ধুম।
সেই সুমধুর স্তব্ধ দুপুর, পাঠশালা-পলায়ন –
ভাবিলাম হায়, আর কি কোথায় ফিরে পাব সে জীবন।
সহসা বাতাস ফেলি গেল শ্বাস শাখা দুলাইয়া গাছে,
দুটি পাকা ফল লভিল ভূতল আমার কোলের কাছে।
ভাবিলাম মনে, বুঝি এতখনে আমারে চিনিল মাতা।
স্নেহের সে দানে বহু সম্মানে বারেক ঠেকানু মাথা।।

হেনকালে হায় যমদূতপ্রায় কোথা হতে এল মালী।
ঝুঁটিবাঁধা উড়ে সপ্তম সুরে পাড়িতে লাগিল গালি।
কহিলাম তবে, ‘আমি তো নীরবে দিয়েছি আমার সব –
দুটি ফল তার করি অধিকার, এত তারি কলরব।’
চিনিল না মোরে, নিয়ে গেল ধরে কাঁধে তুলি লাঠিগাছ;
বাবু ছিপ হাতে পারিষদ-সাথে ধরিতেছিলেন মাছ –
শুনে বিবরণ ক্রোধে তিনি কন, ‘মারিয়া করিব খুন।’
বাবু যত বলে পারিষদ-দলে বলে তার শতগুণ।
আমি কহিলাম, ‘শুধু দুটি আম ভিখ মাগি মহাশয়!’
বাবু কহে হেসে, ‘বেটা সাধুবেশে পাকা চোর অতিশয়!’
আমি শুনে হাসি, আঁখিজলে ভাসি, এই ছিল মোরে ঘটে –
তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে।।


আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার কবিতা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.....গীতাঞ্জলি


আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার                     
চরণধুলার তলে ।
সকল অহংকার হে আমার
ডুবাও চোখের জলে ।                            
নিজেরে করিতে গৌরব দান                            
নিজেরে কেবলই করি অপমান,                            
আপনারে শুধু ঘেরিয়া ঘেরিয়া                                       
ঘুরে মরি পলে পলে ।                            
সকল অহংকার হে আমার                                       
ডুবাও চোখের জলে ।          
আমারে না যেন করি প্রচার                      
আমার আপন কাজে ;          
তোমারি ইচ্ছা করো হে পূর্ণ                      
আমার জীবন-মাঝে ।                            
যাচি হে তোমার চরম শান্তি                            
পরানে তোমার পরম কান্তি                            
আমারে আড়াল করিয়া দাঁড়াও                                        
হৃদয়পদ্মদলে ।                            
সকল অহংকার হে আমার                                        
ডুবাও চোখের জলে ।


সোনার তরী কবিতা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


সোনার তরী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.....সোনার তরী


গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।
কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।
রাশি রাশি ভারা ভারা
ধান কাটা হল সারা,
ভরা নদী ক্ষুরধারা
খরপরশা।
কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।

একখানি ছোটো খেত, আমি একেলা,
চারি দিকে বাঁকা জল করিছে খেলা।
পরপারে দেখি আঁকা
তরুছায়ামসীমাখা
গ্রামখানি মেঘে ঢাকা
প্রভাতবেলা–
এ পারেতে ছোটো খেত, আমি একেলা।

গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে,
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।
ভরা-পালে চলে যায়,
কোনো দিকে নাহি চায়,
ঢেউগুলি নিরুপায়
ভাঙে দু-ধারে–
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।

ওগো, তুমি কোথা যাও কোন্‌ বিদেশে,
বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে।
যেয়ো যেথা যেতে চাও,
যারে খুশি তারে দাও,
শুধু তুমি নিয়ে যাও
ক্ষণিক হেসে
আমার সোনার ধান কূলেতে এসে।

যত চাও তত লও তরণী-‘পরে।
আর আছে?– আর নাই, দিয়েছি ভরে।
এতকাল নদীকূলে
যাহা লয়ে ছিনু ভুলে
সকলি দিলাম তুলে
থরে বিথরে–
এখন আমারে লহ করুণা করে।

ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই– ছোটো সে তরী
আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।
শ্রাবণগগন ঘিরে
ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
শূন্য নদীর তীরে
রহিনু পড়ি–
যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।

                                               ফাল্গুন, ১২৯৮।


যেতে নাহি দিব কবিতা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


যেতে নাহি দিব
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.....সোনার তরী


দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি; বেলা দ্বিপ্রহর;
হেমন্তের রৌদ্র ক্রমে হতেছে প্রখর।
জনশূন্য পল্লিপথে ধূলি উড়ে যায়
মধ্যাহ্ন-বাতাসে; স্নিগ্ধ অশত্থের ছায়
ক্লান্ত বৃদ্ধা ভিখারিণী জীর্ণ বস্ত্র পাতি
ঘুমায়ে পড়েছে; যেন রৌদ্রময়ী রাতি
ঝাঁ ঝাঁ করে চারি দিকে নিস্তব্ধ নিঃঝুম--
শুধু মোর ঘরে নাহি বিশ্রামের ঘুম।
গিয়েছে আশ্বিন-- পূজার ছুটির শেষে
ফিরে যেতে হবে আজি বহুদূরদেশে
সেই কর্মস্থানে। ভৃত্যগণ ব্যস্ত হয়ে
বাঁধিছে জিনিসপত্র দড়াদড়ি লয়ে,
হাঁকাহাঁকি ডাকাডাকি এ-ঘরে ও-ঘরে।
ঘরের গৃহিণী, চক্ষু ছলছল করে,
ব্যথিছে বক্ষের কাছে পাষাণের ভার,
তবুও সময় তার নাহি কাঁদিবার
একদণ্ড তরে; বিদায়ের আয়োজনে
ব্যস্ত হয়ে ফিরে; যথেষ্ট না হয় মনে
যত বাড়ে বোঝা। আমি বলি, "এ কী কাণ্ড!
এত ঘট এত পট হাঁড়ি সরা ভাণ্ড
বোতল বিছানা বাক্স  রাজ্যের বোঝাই
কী করিব লয়ে  কিছু এর রেখে যাই
কিছু লই সাথে।'
সে কথায় কর্ণপাত
নাহি করে কোনো জন। "কী জানি দৈবাৎ
এটা ওটা আবশ্যক যদি হয় শেষে
তখন কোথায় পাবে বিভুঁই বিদেশে?
সোনামুগ সরু চাল সুপারি ও পান;
ও হাঁড়িতে ঢাকা আছে দুই-চারিখান
গুড়ের পাটালি; কিছু ঝুনা নারিকেল;
দুই ভাণ্ড ভালো রাই-সরিষার তেল;
আমসত্ত্ব আমচুর; সের দুই দুধ--
এই-সব শিশি কৌটা ওষুধবিষুধ।
মিষ্টান্ন রহিল কিছু হাঁড়ির ভিতরে,
মাথা খাও, ভুলিয়ো না, খেয়ো মনে করে।'
বুঝিনু যুক্তির কথা বৃথা বাক্যব্যয়।
বোঝাই হইল উঁচু পর্বতের ন্যায়।
তাকানু ঘড়ির পানে, তার পরে ফিরে
চাহিনু প্রিয়ার মুখে; কহিলাম ধীরে,
"তবে আসি'। অমনি ফিরায়ে মুখখানি
নতশিরে চক্ষু-'পরে বস্ত্রাঞ্চল টানি
অমঙ্গল অশ্রুজল করিল গোপন।
বাহিরে দ্বারের কাছে বসি অন্যমন
কন্যা মোর চারি বছরের। এতক্ষণ
অন্য দিনে হয়ে যেত স্নান সমাপন,
দুটি অন্ন মুখে না তুলিতে আঁখিপাতা
মুদিয়া আসিত ঘুমে; আজি তার মাতা
দেখে নাই তারে; এত বেলা হয়ে যায়
নাই স্নানাহার। এতক্ষণ ছায়াপ্রায়
ফিরিতেছিল সে মোর কাছে কাছে ঘেঁষে,
চাহিয়া দেখিতেছিল মৌন নির্নিমেষে
বিদায়ের আয়োজন। শ্রান্তদেহে এবে
বাহিরের দ্বারপ্রান্তে কী জানি কী ভেবে
চুপিচাপি বসে ছিল। কহিনু যখন
"মা গো, আসি' সে কহিল বিষণ্ণ-নয়ন
ম্লান মুখে, "যেতে আমি দিব না তোমায়।'
যেখানে আছিল বসে রহিল সেথায়,
ধরিল না বাহু মোর, রুধিল না দ্বার,
শুধু নিজ হৃদয়ের স্নেহ-অধিকার
প্রচারিল--"যেতে আমি দিব না তোমায়'।
তবুও সময় হল শেষ, তবু হায়
যেতে দিতে হল।
ওরে মোর মূঢ় মেয়ে,
কে রে তুই, কোথা হতে কী শকতি পেয়ে
কহিলি এমন কথা, এত স্পর্ধাভরে--
"যেতে আমি দিব না তোমায়'? চরাচরে
কাহারে রাখিবি ধরে দুটি ছোটো হাতে
গরবিনী, সংগ্রাম করিবি কার সাথে
বসি গৃহদ্বারপ্রান্তে শ্রান্ত ক্ষুদ্র দেহ
শুধু লয়ে ওইটুকু বুকভরা স্নেহ।
ব্যথিত হৃদয় হতে বহু ভয়ে লাজে
মর্মের প্রার্থনা শুধু ব্যক্ত করা সাজে
এ জগতে, শুধু বলে রাখা "যেতে দিতে
ইচ্ছা নাহি'। হেন কথা কে পারে বলিতে
"যেতে নাহি দিব'! শুনি তোর শিশুমুখে
স্নেহের প্রবল গর্ববাণী, সকৌতুকে
হাসিয়া সংসার টেনে নিয়ে গেল মোরে,
তুই শুধু পরাভূত চোখে জল ভ'রে
দুয়ারে রহিলি বসে ছবির মতন,
আমি দেখে চলে এনু মুছিয়া নয়ন।
চলিতে চলিতে পথে হেরি দুই ধারে
শরতের শস্যক্ষেত্র নত শস্যভারে
রৌদ্র পোহাইছে। তরুশ্রেণী উদাসীন
রাজপথপাশে, চেয়ে আছে সারাদিন
আপন ছায়ার পানে। বহে খরবেগ
শরতের ভরা গঙ্গা। শুভ্র খণ্ডমেঘ
মাতৃদুগ্ধ পরিতৃপ্ত সুখনিদ্রারত
সদ্যোজাত সুকুমার গোবৎসের মতো
নীলাম্বরে শুয়ে। দীপ্ত রৌদ্রে অনাবৃত
যুগ-যুগান্তরক্লান্ত দিগন্তবিস্তৃত
ধরণীর পানে চেয়ে ফেলিনু নিশ্বাস।
কী গভীর দুঃখে মগ্ন সমস্ত আকাশ,
সমস্ত পৃথিবী। চলিতেছি যতদূর
শুনিতেছি একমাত্র মর্মান্তিক সুর
"যেতে আমি দিব না তোমায়'। ধরণীর
প্রান্ত হতে নীলাভ্রের সর্বপ্রান্ততীর
ধ্বনিতেছে চিরকাল অনাদ্যন্ত রবে,
"যেতে নাহি দিব। যেতে নাহি দিব।' সবে
কহে "যেতে নাহি দিব'। তৃণ ক্ষুদ্র অতি
তারেও বাঁধিয়া বক্ষে মাতা বসুমতী
কহিছেন প্রাণপণে "যেতে নাহি দিব'।
আয়ুক্ষীণ দীপমুখে শিখা নিব-নিব,
আঁধারের গ্রাস হতে কে টানিছে তারে
কহিতেছে শত বার "যেতে দিব না রে'।
এ অনন্ত চরাচরে স্বর্গমর্ত ছেয়ে
সব চেয়ে পুরাতন কথা, সব চেয়ে
গভীর ক্রন্দন--"যেতে নাহি দিব'।   হায়,
তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়।
চলিতেছে এমনি অনাদি কাল হতে।
প্রলয়সমুদ্রবাহী সৃজনের স্রোতে
প্রসারিত-ব্যগ্র-বাহু জ্বলন্ত-আঁখিতে
"দিব না দিব না যেতে' ডাকিতে ডাকিতে
হু হু করে তীব্রবেগে চলে যায় সবে
পূর্ণ করি বিশ্বতট আর্ত কলরবে।
সম্মুখ-ঊর্মিরে ডাকে পশ্চাতের ঢেউ
"দিব না দিব না যেতে'-- নাহি শুনে কেউ
নাহি কোনো সাড়া।
চারি দিক হতে আজি
অবিশ্রাম কর্ণে মোর উঠিতেছে বাজি
সেই বিশ্ব-মর্মভেদী করুণ ক্রন্দন
মোর কন্যাকণ্ঠস্বরে; শিশুর মতন
বিশ্বের অবোধ বাণী। চিরকাল ধরে
যাহা পায় তাই সে হারায়, তবু তো রে
শিথিল হল না মুষ্টি, তবু অবিরত
সেই চারি বৎসরের কন্যাটির মতো
অক্ষুণ্ন প্রেমের গর্বে কহিছে সে ডাকি
"যেতে নাহি দিব'। ম্লান মুখ, অশ্রু-আঁখি,
দণ্ডে দণ্ডে পলে পলে টুটিছে গরব,
তবু প্রেম কিছুতে না মানে পরাভব,
তবু বিদ্রোহের ভাবে রুদ্ধ কণ্ঠে কয়
"যেতে নাহি দিব'। যত বার পরাজয়
তত বার কহে, "আমি ভালোবাসি যারে
সে কি কভু আমা হতে দূরে যেতে পারে।
আমার আকাঙক্ষা-সম এমন আকুল,
এমন সকল-বাড়া, এমন অকূল,
এমন প্রবল বিশ্বে কিছু আছে আর!'
এত বলি দর্পভরে করে সে প্রচার
"যেতে নাহি দিব'। তখনি দেখিতে পায়,
শুষ্ক তুচ্ছ ধূলি-সম উড়ে চলে যায়
একটি নিশ্বাসে তার আদরের ধন;
অশ্রুজলে ভেসে যায় দুইটি নয়ন,
ছিন্নমূল তরু-সম পড়ে পৃথ্বীতলে
হতগর্ব নতশির। তবু প্রেম বলে,
"সত্যভঙ্গ হবে না বিধির। আমি তাঁর
পেয়েছি স্বাক্ষর-দেওয়া মহা অঙ্গীকার
চির-অধিকার-লিপি।'-- তাই স্ফীত বুকে
সর্বশক্তি মরণের মুখের সম্মুখে
দাঁড়াইয়া সুকুমার ক্ষীণ তনুলতা
বলে, "মৃত্যু তুমি নাই।-- হেন গর্বকথা!
মৃত্যু হাসে বসি। মরণপীড়িত সেই
চিরজীবী প্রেম আচ্ছন্ন করেছে এই
অনন্ত সংসার, বিষণ্ণ নয়ন-'পরে
অশ্রুবাষ্প-সম, ব্যাকুল আশঙ্কাভরে
চির-কম্পমান। আশাহীন শ্রান্ত আশা
টানিয়া রেখেছে এক বিষাদ-কুয়াশা
বিশ্বময়। আজি যেন পড়িছে নয়নে--
দুখানি অবোধ বাহু বিফল বাঁধনে
জড়ায়ে পড়িয়া আছে নিখিলেরে ঘিরে,
স্তব্ধ সকাতর। চঞ্চল স্রোতের নীরে
পড়ে আছে একখানি অচঞ্চল ছায়া--
অশ্রুবৃষ্টিভরা কোন্‌ মেঘের সে মায়া।
তাই আজি শুনিতেছি তরুরক মর্মরে
এত ব্যাকুলতা; অলস ঔদাস্যভরে
মধ্যাহ্নের তপ্ত বায়ু মিছে খেলা করে
শুষ্ক পত্র লয়ে; বেলা ধীরে যায় চলে
ছায়া দীর্ঘতর করি অশত্থের তলে।
মেঠো সুরে কাঁদে যেন অনন্তের বাঁশি
বিশ্বের প্রান্তর-মাঝে; শুনিয়া উদাসী
বসুন্ধরা বসিয়া আছেন এলোচুলে
দূরব্যাপী শস্যক্ষেত্রে জাহ্নবীর কূলে
একখানি রৌদ্রপীত হিরণ্য-অঞ্চল
বক্ষে টানি দিয়া; স্থির নয়নযুগল
দূর নীলাম্বরে মগ্ন; মুখে নাহি বাণী।
দেখিলাম তাঁর সেই ম্লান মুখখানি
সেই দ্বারপ্রান্তে লীন, স্তব্ধ মর্মাহত
মোর চারি বৎসরের কন্যাটির মতো।
 
 
                                                জোড়াসাঁকো, ১৪ কার্তিক, ১২৯৯


ব্যর্থ যৌবন কবিতা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


ব্যর্থ যৌবন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.....সোনার তরী


আজি যে রজনী যায় ফিরাইব তার
কেমনে?
কেন নয়নের জল ঝরিছে বিফল
নয়নে?
এ বেশ ভূষণ লহ সখি লহ,
এ কুসুমমালা হয়েছে অসহ,
এমন যামিনী কাটিল, বিরহ-
শয়নে!
আজি যে রজনী যায় ফিরাইব তার
কেমনে?

আমি বৃথা অভিসারে এ যমুনা পারে
এসেছি!
বহি’ বৃথা মনো-আশা এত ভালবাসা
বেসেছি!
শেষে নিশিশেষে বদন মলিন,
ক্লান্ত চরণ, মন উদাসীন,
ফিরিয়া চলেছি কোন্ সুখহীন
ভবনে?
হায়, যে রজনী যায় ফিরাইব তার
কেমনে?
কত উঠেছিল চাঁদ নিশীথ-অগাধ
আকাশে!
বনে দুলেছিল ফুল গন্ধ-ব্যাকুল
বাতাসে!
তরু-মর্ম্মর, নদী কলতান
কানে লেগেছিল স্বপ্ন সমান,
দুর হতে আসি পশেছিল গান
শ্রবণে,
আজি সে রজনী যায় ফিরাইব তায়
কেমনে?
মনে লেগেছিল হেন আমারে সে যেন
ডেকেছে।
যেন চির যুগ ধরে’ মোরে মনে করে’
রেখেছে!
সে আনিবে বহি ভরা অনুরাগ,
যৌবন নদী করিবে সজাগ,
আসিবে নিশীথে, বাঁধিবে সোহাগ-বাঁধনে।
আহা, সে রজনী যায়, ফিরাইব তায়
কেমনে?

ওগো, ভোলা, ভাল তবে, কাঁদিয়া কি হবে
মিছে আর?
যদি যেতে হল হায়, প্রাণ কেন চায়
পিছে আর?
কুঞ্জদুয়ারে অবোধের মত
রজনী-প্রভাতে বসে রব কত!
এবারের মত বসন্ত-গত
জীবনে।
হায় যে রজনী যায় ফিরাইব তায়
কেমনে!

                                          ১৬ আষাঢ়, ১৩০০।


প্রতীক্ষা কবিতা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


প্রতীক্ষা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.....সোনার তরী


ওরে মৃত্যু, জানি তুই আমার বক্ষের মাঝে
বেঁধেছিস্‌ বাসা,
যেখানে নির্জ্জন কুঞ্জে ফুটে আছে যত মোর
স্নেহ ভালবাসা,
গোপন মনের আশা, জীবনের দুঃখ সুখ,
মর্ম্মের বেদনা,
চির দিবসের যত হাসি-অশ্রু-চিহ্ণ আঁকা
বাসনা সাধনা;
যেখানে নন্দন ছায়ে নিঃশঙ্কে কবিছে খেলা
অন্তরের ধন,
স্নেহের পুত্তলিগুলি, আজন্মের স্নেহস্মৃতি,
আনন্দ-কিরণ;
কত আলো, কত ছায়া, কত ক্ষুদ্র বিহঙ্গের
গীতিময়ী ভাষা,
—ওরে মৃত্যু, জানিয়াছি, তারি মাঝখানে এসে
বেঁধেছিস্‌ বাসা!

নিশিদিন নিরন্তর জগৎ জুড়িয়া খেলা
জীবন চঞ্চল!
চেয়ে দেখি রাজপথে চলেছে অশ্রান্ত গতি
যত পান্থ দল;
রৌদ্রপাণ্ডু নীলাম্বরে, পাখীগুলি উড়ে যায়
প্রাণপূর্ণ বেগে,
সমীরকম্পিত বনে নিশিশেষে নব নব
পুষ্প উঠে জেগে;
চারি দিকে কত শত দেবাশোনা আনাগোনা
প্রভাতে সন্ধ্যায়;
দিনগুলি প্রতি প্রাতে খুলিতেছে জীবনের
নূতন অধ্যায়;
তুমি শুধু এক প্রান্তে বসে আছ অহর্নিশি
স্তব্ধ নেত্র খুলি’,—
মাঝে মাঝে রাত্রিবেলা উঠ পক্ষ ঝাপটিয়া
বক্ষ উঠে দুলি’!

যে সুদূর সমুদ্রের পরপার রাজ্য হতে
আসিয়াছি হেথা,
এনেছ কি সেথাকার নূতন সংবাদ কিছু
গোপন বারতা!
সেথা শব্দহীন তীরে উর্ম্মিগুলি তালে তালে
মহামন্ত্রে বাজে,
সেই ধ্বনি কি করিয়া ধ্বনিয়া তুলিছ মোর
ক্ষুদ্র বক্ষ মাঝে!
রাত্রি দিন ধুক্‌ ধুক্‌ হৃদয়পঞ্জর তটে
অনন্তের ঢেউ,
অবিশ্রাম বাজিতেছে সুগম্ভীর সমতানে
শুনিছে না কেউ!
আমার এ হৃদয়ের ছোট খাট গীতগুলি,
স্নেহ-কলরব,
তারি মাঝে কে আনিল দিশাহীন সমুদ্রের
সঙ্গীত ভৈরব!

তুই কি বাসিস ভাল আমার এ বক্ষবাসী
পরাণ পক্ষীরে?
তাই এর পার্শ্বে এসে কাছে বসেছিস্ ঘেঁষে
অতি ধীরে ধীরে!
দিনরাত্রি নির্ণিমেষে চাহিয়া নেত্রের পানে
নীরব সাধনা,
নিস্তব্ধ আসনে বসি একাগ্র আগ্রহভরে
রুদ্র আরাধনা!
চপল চঞ্চল প্রিয়া ধরা নাহি দিতে চায়
স্থির নাহি থাকে,
মেলি নানাবর্ণ পাখা উড়ে উড়ে চলে যায়
নব নব শাখে;
তুই তবু একমনে মৌনব্রত একাসনে
বসি নিরলস।
ক্রমে সে পড়িবে ধরা, গীত বন্ধ হয়ে যাবে,
মানিবে সে বশ!

তখন কোথায় তারে ভুলায়ে লইয়া যাবি
কোন্ শূন্যপথে!
অচৈতন্য প্রেয়সীরে অবহেলে লয়ে কোলে
অন্ধকার রথে!
যেথায় অনাদি রাত্রী রয়েছে চির-কুমারী,
—আলোক পরশ
একটি রোমাঞ্চ রেখা আঁকেনি তাহার গাত্রে
অসংখ্য বরষ;
সৃজনের পরপ্রান্তে যে অনন্ত অন্তঃপুরে
কভু দৈববশে
দূরতম জ্যোতিষ্কের ক্ষীণতম পদধ্বনি
তিল নাহি পশে;
সেথায় বিরাট পক্ষ দিবি তুই বিস্তারিয়া
বন্ধন বিহীন,
কাঁপিবে বক্ষের কাছে নবপরিণীতা বধু
নূতন স্বাধীন!

ক্রমে সে কি ভুলে যাবে ধরণীর নীড় খানি
তৃণে পত্রে গাঁথা,
এ আনন্দ সূর্য্যালোক, এই স্নেহ, এই গেহ,
এই পুষ্পপাতা?
ক্রমে সে প্রণয়ভরে তোরেও কি করি লবে
আত্মীয় স্বজন?
অন্ধকার বাসরেতে হবে কি দুজনে মিলি
মৌন আলাপন?
তোর স্নিগ্ধ সুগম্ভীর অচঞ্চল প্রেমমূর্ত্তি,
অসীম নির্ভর,
নির্নিমেষ নীলনেত্র, বিশ্বব্যাপ্ত জটাজূট,
নির্ব্বাক্ অধর;
তার কাছে পৃথিবীর চঞ্চল আনন্দগুলি
তুচ্ছ মনে হ’বে,
সমুদ্রে মিশিলে নদী বিচিত্র তটের স্মৃতি
স্মরণে কি র’বে?

ওগো মৃত্যু, ওগো প্রিয়, তবু থাক্‌ কিছুকাল
ভুবন মাঝারে!
এরি মাঝে বধূবেশে অনন্ত বাসর দেশে
লইয়ো না তারে!
এখনো সকল গান করে নি সে সমাপন
সন্ধ্যায় প্রভাতে;
নিজের বক্ষের তাপে মধুর উত্তপ্ত নীড়ে
সুপ্ত আছে রাতে;
পান্থ পাখীদের সাথে এখনো যে যেতে হবে
নব নব দেশে,
সিন্ধুতীরে কুঞ্জবনে নব নব বসন্তের
আনন্দ উদ্দেশে;
ওগো মৃত্যু কেন তুই এখনি তাহার নীড়ে
বসেছিস্‌ এসে?
তার সব ভালবাসা আঁধার করিতে চাস্‌
তুই ভালবেসে?

এ যদি সত্যই হয় মৃত্তিকার পৃথ্বী পরে
মুহূর্ত্তের খেলা,
এই সব মুখোমুখী এই সব দেখাশোনা
ক্ষণিকের মেলা,
প্রাণপণ ভালবাসা সেও যদি হয় শুধু
মিথ্যার বন্ধন,
পরশে খসিয়া পড়ে, তার পরে দণ্ড দুই
অরণ্যে ক্রন্দন,
তুমি শুধু চিরস্থায়ী, তুমি শুধু সীমাশূন্য
মহা পরিণাম,
যত আশা যত প্রেম তোমার তিমিরে লভে
অনন্ত বিশ্রাম,
তবে মৃত্যু, দুরে যাও, এখনি দিয়োনা ভেঙ্গে
এ খেলার পুরী,
ক্ষণেক বিলম্ব কর, আমার দু’দিন হতে
করিয়ো না চুরী!

একদা নামিবে সন্ধ্যা, বাজিবে আরতি শঙ্খ
অদূর মন্দিরে,
বিহঙ্গ নীরব হবে, উঠিবে ঝিল্লির ধ্বনি
অরণ্য গভীরে,
সমাপ্ত হইবে কর্ম্ম, সংসার সংগ্রাম শেষে
জয় পরাজয়,
আসিবে তার ঘোর পান্থের নয়ন পরে
ক্লান্ত অতিশয়,
দিনান্তের শেষ আলো দিগন্তে মিলায়ে যাবে,
ধরণী আঁধার,
সুদূরে জ্বলিবে শুধু অনন্তের যাত্রাপথে
প্রদীপ তারার,
শিয়রে নয়ন-শেষে বসি যারা অনিমেষে
তাহাদের চোখে
আসিবে শ্রান্তির ভার নিদ্রাহীন যামিনীতে
স্তিমিত আলোকে,—

একে একে চলে যাবে আপন আলয়ে সবে
সখাতে সখীতে,
তৈলহীন দীপশিখা নিবিয়া আসিবে ক্রমে
অর্দ্ধ রজনীতে,
উচ্ছ্বসিত সমীরণ আনিবে সুগন্ধ বহি’
অদৃশ্য ফুলের,
অন্ধকার পূর্ণ করি আসিবে তরঙ্গধ্বনি
অজ্ঞাত কুলের,
ওগো মৃত্যু সেই লগ্নে নির্জ্জন শয়নপ্রান্তে
এসো বরবেশে,
আমার পরাণ বধূ ক্লান্ত হস্ত প্রসারিয়া
বহু ভালবেসে
ধরিবে তোমার বাহু; তখন তাহারে তুমি
মন্ত্র পড়ি নিয়ো;
রক্তিম অধর তার নিবিড় চুম্বন দানে
পাণ্ডু করি দিয়ো!

১৭ অগ্রহায়ণ, ১৩০০।


নিরুদ্দেশ যাত্রা কবিতা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


নিরুদ্দেশ যাত্রা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.....সোনার তরী


আর কত দূরে নিয়ে যাবে মোরে
হে সুন্দরি?
বল কোন্‌ পার ভিড়িবে তোমার
সোনার তরী?
যখনি শুধাই, ওগো বিদেশিনী,
তুমি হাস শুধু মধুরহাসিনী,
বুঝিতে না পারি, কি জানি কি আছে
তোমার মনে?
নীরবে দেখাও অঙ্গুলি তুলি’
অকুল সিন্ধু উঠিছে আকুলি’,
দূরে পশ্চিমে ডুবিছে তপন
গগন-কোণে।
কি আছে হোথায়—চলেছি কিসের
অন্বেষণে?

বল দেখি মোরে শুধাই তোমায়,
অপরিচিতা,—
ওই যেথা জ্বলে সন্ধ্যার কূলে
দিনের চিতা,
ঝলিতেছে জল তরল অনল,
গলিয়া পড়িছে অম্বরতল,
দিক্‌বধু যেন ছলছল আঁখি
অশ্রুজলে,
হোথায় কি আছে আলয় তোমার
উর্ম্মিমুখর সাগরের পার,
মেঘচুম্বিত অন্তগিরির
চরণতলে?
তুমি হাস শুধু মুখপানে চেয়ে
কথা না বলে’!

হুহু ক’রে বায়ু ফেলিছে সতত
দীর্ঘশ্বাস!
অন্ধ আবেগে করে গর্জ্জন
জলোচ্ছ্বাস!
সংশয়ময় ঘননীল নীর
কোন দিকে চেয়ে নাহি হেরি তীর,
অসীম রোদন জগৎ প্লাবিয়া
দুলিছে যেন;
তারি পরে ভাসে তরুণী হিরণ,
তারি পরে পড়ে সন্ধ্যা-কিরণ,
তারি মাঝে বসি এ নীরব হাসি
হাসিছ কেন?
আমি ত বুঝি না কি লাগি তোমার
বিলাস হেন?
যখন প্রথম ডেকেছিলে তুমি
“কে যাবে সাথে?
চাহি বারেক তোমার নয়নে
নবীন প্রাতে।
দেখালে সমুখে প্রসারি কর
পশ্চিম পানে অসীম সাগর,
চঞ্চল আনো আশার মতন
কাঁপিছে জলে।
তরীতে উঠিয়া শুধানু তখন
আছে কি হোথায় নবীন জীবন,
আশার স্বপন ফলে কি হোথায়
সোনার ফলে?
মুখপানে চেয়ে হাসিলে কেবল
কথা না বলে’!

তারপরে কভু উঠিয়াছে মেঘ,
কখনো রবি,
কখনো ক্ষুব্ধ সাগর, কখনো
শান্ত ছবি।
বেলা বহে’ যায়, পালে লাগে বায়,
সোনার তরণী কোথা চলে’ যায়,
পশ্চিমে হেরি নামিছে তপন
অস্তাচলে।
এখন বারে শুধাই তােমায়
স্নিগ্ধ মরণ আছে কি হােথায়,
আছে কি শান্তি, আছে কি সুপ্তি
তিমির তলে?
হাসিতেছ তুমি তুলিয়া নয়ন
কথা না বলে!

আঁধার রজনী আসিবে এখনি
মেলিয়া পাখা,
সন্ধ্যা-আকাশে স্বর্ণ-শালােক
পড়িবে ঢাকা।
শুধু ভাসে তব দেহ-সৌরভ,
শুধু কানে আসে জল-কলরব,
গায়ে উড়ে পড়ে বায়ু
ভরে, তবকেশের রাশি।
বিকল হৃদয় বিবশ শরীর
ডাকিয়া তােমারে কহিব অধীর-
“কোথা আছ ওগাে করহ পরশ
নিকটে আসি”
কহিবে না কথা, দেখিতে পাব না
নীরব হাসি।

                                                  ২৭ অগ্রহায়ণ, ১৩০০।


পুরস্কার কবিতা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


পুরস্কার
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.....সোনার তরী


সেদিন বরষা ঝরঝর ঝরে,
    কহিল কবির স্ত্রী--
"রাশি রাশি মিল করিয়াছ জড়ো,
রচিতেছ বসি পুঁথি বড়ো বড়ো,
মাথার উপরে বাড়ি পড়ো-পড়ো
    তার খোঁজ রাখ কি!
গাঁথিছ ছন্দ দীর্ঘ হ্রস্ব--
মাথা ও মুণ্ড, ছাই ও ভস্ম ;
মিলিবে কি তাহে হস্তী অশ্ব,
    না মিলে শস্যকণা    ॥
অন্ন জোটে না, কথা জোটে মেলা,
নিশিদিন ধরে এ কী ছেলেখেলা!
ভারতীরে ছাড়ি ধরো এইবেলা
      লক্ষ্মীর উপাসনা॥
ওগো ফেলে দাও পুঁথি ও লেখনী,
যা করিতে হয় করহ এখনি।
এত শিখিয়াছ, এটুকু শেখ নি
    কিসে কড়ি আসে দুটো!'
দেখি সে মুরতি সর্বনাশিয়া
কবির পরান উঠিল ত্রাসিয়া,
পরিহাসছলে ঈষৎ হাসিয়া
    কহে জুড়ি করপুট--॥
"ভয় নাহি করি ও মুখ-নাড়ারে,
লক্ষ্মী সদয় লক্ষ্মীছাড়ারে,
ঘরেতে আছেন নাইকো ভাঁড়ারে
    এ কথা শুনিবে কে বা!   ॥
আমার কপালে বিপরীত ফল,
চপলা লক্ষ্মী মোরে অচপল,
ভারতী না থাকে থির এক পল
       এত করি তাঁর সেবা॥
তাই তো কপাটে লাগাইয়া খিল
স্বর্গে মর্ত্যে খুঁজিতেছি মিল,
আনমনা যদি হই এক তিল
       অমনি সর্বনাশ।'
মনে মনে হাসি মুখ করি ভার
কহে কবিজায়া, "পারি নেকো আর,
ঘর-সংসার গেল ছারেখার,
       সব তাতে পরিহাস।'   ॥
এতেক বলিয়া বাঁকায়ে মুখানি
শিঞ্জিত করি কাঁকন দুখানি
চঞ্চল করে অঞ্চল টানি
       রোষছলে যায় চলি।
হেরি সে ভুবন-গরব-দমন
অভিমানবেগে অধীর গমন,
উচাটন কবি কহিল, "অমন
       যেয়ো না হৃদয় দলি।
ধরা নাহি দিলে ধরিব দু-পায়
কী করিতে হবে বলো সে উপায়,
ঘর ভরি দিব সোনায় রুপায়--
       বুদ্ধি জোগাও তুমি।
এতটুকু ফাঁকা যেখানে যা পাই
তোমার মুরতি সেখানে চাপাই,
বুদ্ধির চাষ কোনোখানে নাই--
            সমস্ত মরুভূমি।'
"হয়েছে, হয়েছে, এত ভালো নয়'
হাসিয়া রুষিয়া গৃহিণী ভনয়,
"যেমন বিনয় তেমনি প্রণয়
আমার কপালগুণে।
কথার কখনো ঘটে নি অভাব,
যখনি বলেছি পেয়েছি জবাব;
একবার ওগো বাক্য-নবাব,
         চলো দেখি কথা শুনে।
শুভ দিনখন দেখো পাঁজি খুলি,
সঙ্গে করিয়া লহো পুঁথিগুলি,
ক্ষণিকের তরে আলস্য ভুলি
        চলো রাজসভা-মাঝে।
আমাদের রাজা গুণীর পালক,
মানুষ হইয়া গেল কত লোক--
ঘরে তুমি জমা করিলে শোলোক
         লাগিবে কিসের কাজে!'
কবির মাথায় ভাঙি পড়ে বাজ;
ভাবিল, "বিপদ দেখিতেছি আজ,
কখনো জানি নে রাজা-মহারাজ--
         কপালে কী জানি আছে!'
মুখে হেসে বলে, "এই বৈ নয়!
আমি বলি আরো কী করিতে হয়--
প্রাণ দিতে পারি, শুধু জাগে ভয়
         বিধবা হইবে পাছে।
যেতে যদি হয় দেরিতে কী কাজ,
ত্বরা করে তবে নিয়ে এসো সাজ--
হেমকুণ্ডল, মণিময় তাজ,
         কেয়ূর,কনকহার।
বলে দাও মোর সারথিরে ডেকে
ঘোড়া বেছে নেয় ভালো ভালো দেখে,
কিংকরগণ সাথে যাবে কে কে
         আয়োজন করো তার।'
ব্রাহ্মণী কহে, "মুখাগ্রে যার
বাধে না কিছুই, কী চাহে সে আর,
মুখ ছুটাইলে রথাশ্বে তার
         না দেখি আবশ্যক।
নানা বেশভূষা হীরা রুপা সোনা
এনেছি পাড়ার করি উপাসনা--
সাজ করে লও পুরায়ে বাসনা,
         রসনা ক্ষান্ত হোক।'
এতেক বলিয়া ত্বরিতচরণ
আনে বেশবাস নানান-ধরন;
কবি ভাবে মুখ করি বিবরন,
       "আজিকে গতিক মন্দ।'
গৃহিণী স্বয়ং নিকটে বসিয়া
তুলিল তাহারে মাজিয়া ঘষিয়া,
আপনার হাতে যতনে কষিয়া
         পরাইল কটিবন্ধ।
উষ্ণীষ আনি মাথায় চড়ায়,
কণ্ঠী আনিয়া কণ্ঠে জড়ায়,
অঙ্গদ দুটি বাহুতে পরায়,
         কুণ্ডল দেয় কানে।
অঙ্গে যতই চাপায় রতন
কবি বসি থাকে ছবির মতন,
প্রেয়সীর নিজ হাতের যতন
         সেও আজি হার মানে।
এই মতে দুই প্রহর ধরিয়া
বেশভূষা সব সমাধা করিয়া
গৃহিণী নিরখে ঈষৎ সরিয়া
         বাঁকায়ে মধুর গ্রীবা।
হেরিয়া কবির গম্ভীর মুখ
হৃদয়ে উপজে মহা কৌতুক--
হাসি উঠি কহে ধরিয়া চিবুক,
"আ মরি সেজেছ কিবা!'
ধরিল সমুখে আরশি আনিয়া,
কহিল বচন অমিয় ছানিয়া,
"পুরনারীদের পরান হানিয়া
         ফিরিয়া আসিবে আজি--
তখন দাসীরে ভুলো না গরবে,
এই উপকার মনে রেখো তবে,
মোরেও এমনি পরাইতে হবে
         রতনভূষণরাজি।'
কোলের উপরে বসি', বাহুপাশে
বাঁধিয়া কবিরে সোহাগে সহাসে
কপোল রাখিয়া কপোলের পাশে
         কানে কানে কথা কয়।
দেখিতে দেখিতে কবির অধরে
হাসিরাশি আর কিছুতে না ধরে,
মুগ্ধ হৃদয় গলিয়া আদরে
         ফাটিয়া বাহির হয়।
কহে উচ্ছ্বসি, "কিছু না মানিব,
এমনি মধুর শ্লোক বাখানিব,
রাজভাণ্ডার টানিয়া আনিব
         ও রাঙা চরণতলে।'
বলিতে বলিতে বুক উঠে ফুলি,
উষ্ণীষ-পরা মস্তক তুলি
পথে বাহিরায় গৃহদ্বার খুলি--
         দ্রুত রাজগৃহে চলে।
কবির রমণী কুতূহলে ভাসে,
তাড়াতাড়ি উঠি বাতায়নপাশে
উঁকি মারি চায়, মনে মনে হাসে,
         কালো চোখে আলো নাচে।
কহে মনে মনে বিপুল পুলকে,
"রাজপথ দিয়ে চলে এত লোকে
এমনটি আর পড়িল না চোখে
         আমার যেমন আছে।'
এদিকে কবির উৎসাহ ক্রমে
নিমেষে নিমেষে আসিতেছে কমে,
যখন পশিল নৃপ-আশ্রমে
         মরিতে পাইলে বাঁচে।
রাজসভাসদ্‌ সৈন্য পাহারা
গৃহিণীর মতো নহে তো তাহারা,
সারি সারি দাড়ি করে দিশাহারা--
         হেথা কি আসিতে আছে!
হেসে ভালোবেসে দুটো কথা কয়
রাজসভাগৃহ হেন ঠাঁই নয়,
মন্ত্রী হইতে দ্বারী মহাশয়
         সবে গম্ভীর মুখ।
মানুষে কেন যে মানুষের প্রতি
ধরি আছে হেন যমের মুরতি,
তাই ভাবি কবি না পায় ফুরতি
         দমি যায় তার বুক।
বসি মহারাজ মহেন্দ্র রায়
মহোচ্চ গিরি-শিখরের প্রায়,
জন-অরণ্য হেরিছে হেলায়
         অচল অটল-ছবি।
কৃপানির্ঝর পড়িছে ঝরিয়া
শত শত দেশ সরস করিয়া,
সে মহা মহিমা নয়ন ভরিয়া
         চাহিয়া দেখিল কবি।
বিচার সমাধা হল যবে, শেষে
ইঙ্গিত পেয়ে মন্ত্রী-আদেশে
জোড়করপুটে দাঁড়াইল এসে
         দেশের প্রধান চর।
অতি সাধুমত আকারপ্রকার,
এক তিল নাহি মুখের বিকার,
ব্যবসা যে তাঁর মানুষ-শিকার
         নাহি জানে কোনো নর।
ব্রত নানামত সতত পালয়ে,
এক কানাকড়ি মূল্য না লয়ে
ধর্মোপদেশ আলয়ে আলয়ে
         বিতরিছে যাকে তাকে।
চোরা কটাক্ষ চক্ষে ঠিকরে--
কী ঘটিছে কার, কে কোথা কী করে,
পাতায় পাতায় শিকড়ে শিকড়ে
         সন্ধান তার রাখে।
নামাবলী গায়ে বৈষ্ণবরূপে
যখন সে আসি প্রণমিল ভূপে,
মন্ত্রী রাজারে অতি চুপে চুপে
         কী করিল নিবেদন।
অমনি আদেশ হইল রাজার,
"দেহো এঁরে টাকা পঞ্চ হাজার।'
"সাধু সাধু' কহে সভার মাঝার
         যত সভাসদজন।
পুলক প্রকাশে সবার গাত্রে,
"এ-যে দান ইহা যোগ্য পাত্রে,
দেশের আবালবনিতা-মাত্রে
         ইথে না মানিবে দ্বেষ।'
সাধু নুয়ে পড়ে নম্রতাভরে,
দেখি সভাজন "আহা আহা' করে,
মন্ত্রীর শুধু জাগিল অধরে
       ঈষৎ হাস্যলেশ।
আসে গুটি গুটি বৈয়াকরণ
ধূলি-ভরা দুটি লইয়া চরণ
চিহ্নিত করি রাজাস্তরণ
       পবিত্র পদপঙ্কে।
ললাটে বিন্দু বিন্দু ঘর্ম,
বলি-অঙ্কিত শিথিল চর্ম,
প্রখরমূর্তি অগ্নিশর্ম,
       ছাত্র মরে আতঙ্কে।
কোনো দিকে কোনো লক্ষ না ক'রে
পড়ি গেল শ্লোক বিকট হাঁ ক'রে,
মটর-কড়াই মিশায়ে কাঁকরে
       চিবাইল যেন দাঁতে।
কেহ তার নাহি বুঝে আগুপিছু,
সবে বসি থাকে মাথা করি নিচু;
রাজা বলে, "এঁরে দক্ষিণা কিছু
       দাও দক্ষিণ হাতে।'
তার পরে এল গনৎকার,
গণনায় রাজা চমৎকার,
টাকা ঝন্‌ ঝন্‌ ঝনৎকার
       বাজায়ে সে গেল চলি।
আসে এক বুড়া গণ্যমান্য
করপুটে লয়ে দূর্বাধান্য
রাজা তাঁর প্রতি অতি বদান্য
       ভরিয়া দিলেন থলি।
আসে নট-ভাট রাজপুরোহিত
কেহ একা কেহ শিষ্য-সহিত,
কারো বা মাথায় পাগড়ি লোহিত
       কারো বা হরিৎবর্ণ।
আসে দ্বিজগণ পরমারাধ্য--
কন্যার দায়, পিতার শ্রাদ্ধ--
যার যথামত পায় বরাদ্দ,
       রাজা আজি দাতাকর্ণ।
যে যাহার সবে যায় স্বভবনে,
কবি কী করিবে ভাবে মনে মনে,
রাজা দেখে তারে সভাগৃহকোণে
       বিপন্নমুখছবি।
কহে ভূপ, "হোথা বসিয়া কে ওই
এসো তো মন্ত্রী, সন্ধান লই।'
কবি কহি উঠে, "আমি কেহ নই,
       আমি শুধু এক কবি।'
রাজা কহে, "বটে! এসো এসো তবে,
আজিকে কাব্য-আলোচনা হবে।'
বসাইলা কাছে মহাগৌরবে
       ধরি তার কর দুটি।
মন্ত্রী ভাবিল, "যাই এইবেলা,
এখন তো শুরু হবে ছেলেখেলা।'
কহে, "মহারাজ, কাজ আছে মেলা,
       আদেশ পাইলে উঠি।'
রাজা শুধু মৃদু নাড়িলা হস্ত,
নৃপ-ইঙ্গিতে মহা তটস্থ
বাহির হইয়া গেল সমস্ত
       সভাস্থ দলবল--
পাত্র মিত্র অমাত্য আদি,
অর্থী প্রার্থী বাদী প্রতিবাদী,
উচ্চ তুচ্ছ বিবিধ উপাধি
       বন্যার যেন জল।
চলি গেল যবে সভ্যসুজন,
মুখোমুখি করি বসিলা দুজন,
রাজা বলে, "এবে কাব্যকূজন
          আরম্ভ করো কবি॥'
কবি তবে দুই কর জুড়ি বুকে
বাণীবন্দনা করে নতমুখে,
"প্রকাশো, জননী, নয়নসমুখে
                 প্রসন্ন মুখছবি॥
বিমল মানসসরসবাসিনী,
শুক্লবসনা শুভ্রহাসিনী,
বীণাগঞ্জিত মঞ্জুভাষিণী
       কমলকুঞ্জাসনা,
তোমারে হৃদয়ে করিয়া আসীন
সুখে গৃহকোণে ধনমানহীন
খ্যাপার মতন আছি চিরদিন
           উদাসীন আনমনা॥
চারি দিকে সবে বাঁটিয়া দুনিয়া
আপন অংশ নিতেছে গুনিয়া--
আমি তব স্নেহবচন শুনিয়া
       পেয়েছি স্বরগসুধা॥
সেই মোর ভালো, সেই বহু মানি--
তবু মাঝে মাঝে কেঁদে ওঠে প্রাণী,
সুরের খাদ্যে জান তো মা বাণী,
       নরের মিটে না ক্ষুধা।
যা হবার হবে, সে কথা ভাবি না,
মা গো, একবার ঝংকারো বীণা,
ধরহ রাগিণী বিশ্বপ্লাবিনা
       অমৃত-উৎস-ধারা॥
যে রাগিণী শুনি নিশিদিনমান
বিপুল হর্ষে দ্রব ভগবান
মলিন মর্ত-মাঝে বহমান
নিয়ত আত্মহারা।
যে রাগিণী সদা গগন ছাপিয়া
হোমশিখাসম উঠিছে কাঁপিয়া,
অনাদি অসীমে পড়িছে ঝাঁপিয়া,
           বিশ্বতন্ত্রী হতে॥
যে রাগিণী চির-জন্ম ধরিয়া
চিত্তকুহরে উঠে কুহরিয়া,
অশ্রুহাসিতে জীবন ভরিয়া,
       ছুটে সহস্র স্রোতে।
কে আছে কোথায়, কে আসে কে যায়,
নিমেষে প্রকাশে, নিমেষে মিলায়--
বালুকার 'পরে কালের বেলায়
       ছায়া-আলোকের খেলা!
জগতের যত রাজা-মহারাজ
কাল ছিল যারা কোথা তারা আজ,
সকালে ফুটিছে সুখদুখলাজ--
       টুটিছে সন্ধ্যাবেলা।
শুধু তার মাঝে ধ্বনিতেছে সুর
বিপুল বৃহৎ গভীর মধুর--
চিরদিন তাহে আছে ভরপুর
       মগন গগনতল।
যে জন শুনেছে সে অনাদি ধ্বনি
ভাসায়ে দিয়েছে হৃদয়তরণী;
জানে না আপনা, জানে না ধরণী,
       সংসার-কোলাহল।
সে জন পাগল, পরান বিকল--
ভবকূল হতে ছিঁড়িয়া শিকল
কেমনে এসেছে ছাড়িয়া সকল
       ঠেকেছে চরণে তব।
তোমার অমল কমলগন্ধ
হৃদয়ে ঢালিছে মহা আনন্দ--'
অপূর্ব গীত, আলোক ছন্দ
         শুনিছে নিত্য নব।
বাজুক সে বীণা, মজুক ধরণী,
বারেকের তরে ভুলাও জননী,
কে বড়ো কে ছোটো, কে দীন কে ধনী,
         কেবা আগে কেবা পিছে--॥
কার জয় হল কার পরাজয়,
কাহার বৃদ্ধি কার হল ক্ষয়,
কেবা ভালো আর কেবা ভালো নয়,
         কে উপরে কেবা নীচে।
গাঁথা হয়ে যাক এক গীতরবে
ছোটো জগতের ছোটো-বড়ো সবে,
সুখে প'ড়ে রবে পদপল্লবে
         যেন মালা একখানি।
তুমি মানসের মাঝখানে আসি
দাঁড়াও মধুর মুরতি বিকাশি,
কুন্দবরন সুন্দর হাসি
         বীণাহাতে বীণাপাণি।
ভাসিয়া চলিবে রবিশশীতারা
সারি সারি যত মানবের ধারা
অনাদিকালের পান্থ যাহারা
         তব সংগীতস্রোতে।
দেখিতে  পাইব ব্যোমে মহাকাল
ছন্দে ছন্দে বাজাইছে তাল,
দশ দিক্‌বধূ খুলি কেশজাল
         নাচে দশ দিক হতে।'
এতেক বলিয়া ক্ষণপরে কবি
করুণ কথায় প্রকাশিল ছবি
পুণ্যকাহিনী রঘুকুলরবি
       রাঘবের ইতিহাস--
অসহ দুঃখ সহি নিরবধি
কেমনে জনম গিয়েছে দগধি,
জীবনের শেষ দিবস অবধি
       অসীম নিরাশ্বাস।
কহিল, "বারেক ভাবি দেখো মনে
সেই এক দিন কেটেছে কেমনে
যেদিন মলিন বাকল-বসনে
       চলিলা বনের পথে--
ভাই লক্ষ্ণণ বয়স নবীন,
ম্লান ছায়া-সম বিষাদ-বিলীন
নববধূ সীতা আভরণহীন
       উঠিলা বিদায়-রথে।
রাজপুরী-মাঝে উঠে হাহাকার,
প্রজা কাঁদিতেছে পথে সারে সার--
এমন বজ্র কখনো কি আর
       পড়েছে এমন ঘরে!
অভিষেক হবে, উৎসবে তার
আনন্দময় ছিল চারি ধার
মঙ্গলদীপ নিবিয়া আঁধার
       শুধু নিমেষের ঝড়ে।
আর-এক দিন, ভেবে দেখো মনে,
যে দিন শ্রীরাম লয়ে লক্ষ্ণণে
ফিরিয়া নিভৃত কুটির-ভবনে
       দেখিলা জানকী নাহি--
"জানকী জানকী' আর্ত রোদনে
ডাকিয়া ফিরিলা কাননে কাননে,
মহা অরণ্য আঁধার-আননে
       রহিল নীরবে চাহি।
তার পরে দেখো শেষ কোথা এর,
ভেবে দেখো কথা সেই দিবসের--
এত বিষাদের  এত বিরহের
         এত সাধনের ধন,
সেই সীতাদেবী রাজসভামাঝে
বিদায়-বিনয়ে নমি রঘুরাজে
দ্বিধা ধরাতলে অভিমানে লাজে
        হইলা অদর্শন।
সে-সকল দিন সেও চলে যায়;
সে অসহ শোক, চিহ্ন কোথায়-
যায় নি তো এঁকে ধরণীর গায়
         অসীম দগ্ধ রেখা।
দ্বিধা ধরাভূমি জুড়েছে আবার,
দণ্ডকবনে ফুটে ফুলভার,
সরযূর কূলে দুলে তৃণসার
         প্রফুল্ল শ্যামলেখা।
শুধু সে দিনের একখানি সুর
চিরদিন ধ'রে বহু বহু দূর
কাঁদিয়া হৃদয় করিছে বিধুর
         মধুর করুণ তানে;
সে মহাপ্রাণের মাঝখানটিতে
যে মহারাগিণী আছিল ধ্বনিতে
আজিও সে গীত মহাসংগীতে
         বাজে মানবের কানে।'
তার পরে কবি কহিল সে কথা,
কুরুপাণ্ডব-সমর বারতা--
"গৃহবিবাদের ঘোর মত্ততা
         ব্যাপিল সর্ব দেশ;
দুইটি যমজ তরু পাশাপাশি,
ঘর্ষণে জ্বলে হুতাশনরাশি,
মহাদাবানল ফেলে শেষে গ্রাসি
         অরণ্য-পরিবেশ।
এক গিরি হতে দুই স্রোত-পারা
দুইটি শীর্ণ বিদ্বেষধারা
সরীসৃপগতি মিলিল তাহারা
         নিষ্ঠুর অভিমানে--
দেখিতে দেখিতে হল উপনীত
ভারতের যত ক্ষত্র-শোণিত--
ত্রাসিত ধরণী করিল ধ্বনিত
         প্রলয়বন্যা-গানে।
দেখিতে দেখিতে ডুবে গেল কূল,
আত্ম ও পর হয়ে গেল ভুল,
গৃহবন্ধন করি নির্মূল
         ছুটিল রক্তধারা;
ফেনায়ে উঠিল মরণাম্বুধি,
বিশ্ব রহিল নিশ্বাস রুধি,
কাঁপিল গগন শত আঁখি মুদি
         নিবায়ে সূর্যতারা।
সমরবন্যা যবে অবসান
সোনার ভারত বিপুল শ্মশান,
রাজগৃহ যত ভূতল-শয়ান
         পড়ে আছে ঠাঁই ঠাঁই--
ভীষণা শান্তি রক্তনয়নে
বসিয়া শোণিত-পঙ্কশয়নে,
চাহি ধরা-পানে আনত বয়নে
         মুখেতে বচন নাই।
বহুদিন পরে ঘুচিয়াছে খেদ,
মরণে মিটেছে সব বিচ্ছেদ,
সমাধা যজ্ঞ মহা নরমেধ
         বিদ্বেষ-হুতাশনে।
সকল কামনা করিয়া পূর্ণ
সকল দম্ভ করিয়া চূর্ণ
পাঁচ ভাই গিয়া বসিলা শূন্য
         স্বর্ণসিংহাসনে।
স্তব্ধ প্রাসাদ বিষাদ-আঁধার,
শ্মশান হইতে আসে হাহাকার--
রাজপুরবধূ যত অনাথার
         মর্ম-বিদার রব।
"জয় জয় জয় পাণ্ডুতনয়'
সারি সারি দ্বারী দাঁড়াইয়া কয়;
পরিহাস ব'লে আজি মনে হয়,
         মিছে মনে হয় সব।
কালি যে ভারত সারাদিন ধরি
অট্ট গরজে অম্বর ভরি
রাজার রক্তে খেলেছিল হোরি
         ছাড়ি কুলভয়লাজে,
পরদিনে চিতাভস্ম মাখিয়া
সন্ন্যাসীবেশে অঙ্গ ঢাকিয়া
বসি একাকিনী শোকার্ত হিয়া
         শূন্য শ্মশান-মাঝে।
কুরুপাণ্ডব মুছে গেছে সব,
সে রণরঙ্গ হয়েছে নীরব,
সে চিতাবহ্নি অতি ভৈরব
         ভস্মও নাহি তার;
যে ভূমি লইয়া এত হানাহানি
সে আজি কাহার তাহাও না জানি--
কোথা ছিল রাজা, কোথা রাজধানী
         চিহ্ন নাহিকো আর।
তবু কোথা হতে আসিছে সে স্বর--
যেন সে অমর সমর-সাগর
গ্রহণ করেছে নব কলেবর
         একটি বিরাট গানে;
বিজয়ের শেষে সে মহাপ্রয়াণ,
সফল আশার বিষাদ মহান,
উদাস শান্তি করিতেছে দান
         চিরমানবের প্রাণে।
"হায়, এ ধরায় কত অনন্ত
বরষে বরষে শীত বসন্ত
সুখে দুখে ভরি দিক্‌দিগন্ত
         হাসিয়া গিয়াছে ভাসি;
এমনি বরষা আজিকার মতো
কতদিন কত হয়ে গেছে গত,
নব মেঘভারে গগন আনত
         ফেলেছে অশ্রুরাশি।
যুগে যুগে লোক গিয়েছে এসেছে,
দুখিরা কেঁদেছে, সুখীরা হেসেছে,
প্রেমিক যে জন ভালো সে বেসেছে
         আজি আমাদেরি মতো--
তারা গেছে, শুধু তাহাদের গান
দু হাতে ছড়ায়ে করে গেছে দান;
দেশে দেশে, তার নাহি পরিমাণ,
         ভেসে ভেসে যায় কত।
শ্যামলা বিপুলা এ ধরার পানে
চেয়ে দেখি আমি মুগ্ধ নয়ানে;
সমস্ত প্রাণে কেন যে কে জানে
         ভরে আসে আঁখিজল--
বহু মানবের প্রেম দিয়ে ঢাকা,
বহু দিবসের সুখে দুখে আঁকা,
লক্ষ যুগের সংগীতে মাখা
         সুন্দর ধরাতল।
এ ধরার মাঝে তুলিয়া নিনাদ
চাহি নে করিতে বাদপ্রতিবাদ,
যে কদিন আছি মানসের সাধ
         মিটাব আপন মনে--
যার যাহা আছে তার থাক্‌ তাই,
কারো অধিকারে যেতে নাহি চাই
শান্তিতে যদি থাকিবারে পাই
         একটি নিভৃত কোণে।
শুধু বাঁশিখানি হাতে দাও তুলি,
বাজাই বসিয়া প্রাণমন খুলি,
পুষ্পের মতো সংগীতগুলি
         ফুটাই আকাশভালে--
অন্তর হতে আহরি বচন
আনন্দলোক করি বিরচন,
গীতরসধারা করি সিঞ্চন
        সংসার-ধূলিজালে।
অতি দুর্গম সৃষ্টিশিখরে
অসীম কালের মহাকন্দরে
সতত বিশ্বনির্ঝর ঝরে।
         ঝর্ঝর সংগীতে,
স্বরতরঙ্গ যত গ্রহতারা
ছুটিছে শূন্যে উদ্দেশহারা--
সেথা হতে টানি লব গীতধারা
         ছোটো এই বাঁশরিতে।
ধরণীর শ্যাম করপুটখানি
ভরি দিব আমি সেই গীত আনি,
বাতাসে মিশায়ে দিব এক বাণী
         মধুর-অর্থ-ভরা।
নবীন আষাঢ়ে রচি নব মায়া
এঁকে দিয়ে যাব ঘনতর ছায়া,
করে দিয়ে যাব বসন্তকায়া
         বাসন্তীবাস-পরা।
ধরণীর তলে গগনের গায়
সাগরের জলে, অরণ্য-ছায়
আরেকটুখানি নবীন আভায়
         রঙিন করিয়া দিব।
সংসার-মাঝে  দু-একটি সুর
রেখে দিয়ে যাব করিয়া মধুর,
দু-একটি কাঁটা করি দিব দূর--
         তার পরে ছুটি নিব।
সুখহাসি আরো হবে উজ্জ্বল,
সুন্দর হবে নয়নের জল,
স্নেহসুধামাখা বাসগৃহতল
         আরো আপনার হবে।
প্রেয়সী নারীর নয়নে অধরে
আরেকটু মধু দিয়ে যাব ভরে,
আরেকটু স্নেহ শিশুমুখ-'পরে
         শিশিরের মতো রবে।
না পারে বুঝাতে, আপনি না বুঝে,
মানুষ ফিরিছে কথা খুঁজে খুঁজে,
কোকিল যেমন পঞ্চমে কূজে
         মাগিছে তেমনি সুর--
কিছু ঘুচাইব সেই ব্যাকুলতা,
কিছু মিটাইব প্রকাশের ব্যথা,
বিদায়ের আগে দু-চারিটা কথা
         রেখে যাব সুমধুর।
থাকো হৃদাসনে জননী ভারতী--
তোমারি চরণে প্রাণের আরতি,
চাহি না চাহিতে আর কারো প্রতি,
         রাখি না কাহারো আশা।
কত সুখ ছিল, হয়ে গেছে দুখ;
কত বান্ধব হয়েছে বিমুখ
ম্লান হয়ে গেছে কত উৎসুক
         উন্মুখ ভালোবাসা।
শুধু ও-চরণ হৃদয়ে বিরাজে,
শুধু ওই বীণা চিরদিন বাজে,
স্নেহসুরে ডাকে অন্তর-মাঝে--
         আয় রে বৎস, আয়,
ফেলে রেখে আয় হাসিক্রন্দন,
ছিঁড়ে আয় যত মিছে বন্ধন,
হেথা ছায়া আছে চিরনন্দন
         চিরবসন্ত বায়।
সেই ভালো মা গো, যাক যাহা যায়,
জন্মের মতো বরিনু তোমায়,
কমলগন্ধ কোমল দু-পায়
        বার বার নমো নম।'
এত বলি কবি থামাইল গান,
বসিয়া রহিল মুগ্ধ নয়ান,
বাজিতে লাগিল হৃদয় পরান
         বীণাঝংকার-সম।
পুলকিত রাজা, আঁখি ছলছল,
আসন ছাড়িয়া নামিলা ভূতল,
দু-বাহু বাড়ায়ে, পরান উতল,
         কবিরে লইলা বুকে।
কহিলা, "ধন্য, কবি গো, ধন্য,
আনন্দে মন সমাচ্ছন্ন,
তোমারে কী আমি কহিব অন্য--
         চিরদিন থাকো সুখে।
ভাবিয়া না পাই কী দিব তোমারে,
করি পরিতোষ কোন্‌ উপহারে,
যাহা-কিছু আছে রাজভাণ্ডারে
         সব দিতে পারি আনি।'
প্রেমোচ্ছ্বসিত আনন্দ-জলে
ভরি দু নয়ন কবি তাঁরে বলে,
"কণ্ঠ হইতে দেহো মোর গলে
         ওই ফুলমালাখানি।'
মালা বাঁধি কেশে কবি যায় পথে;
কেহ শিবিকায়, কেহ ধায় রথে,
নানা দিকে লোক যায় নানা মতে
         কাজের অম্বেষণে।
কবি নিজ মনে ফিরিছে লুব্ধ,
যেন সে তাহার নয়ন মুগ্ধ
কল্পধেনুর অমৃত-দুগ্ধ
         দোহন করিছে মনে।
কবির রমণী বাঁধি কেশপাশ,
সন্ধ্যার মতো পরি রাঙা বাস
বসি একাকিনী বাতায়ন-পাশ,
         সুখহাস মুখে ফুটে।
কপোতের দল চারি দিকে ঘিরে
নাচিয়া ডাকিয়া বেড়াইছে ফিরে,
যবের কণিকা তুলিয়া সে ধীরে
         দিতেছে চঞ্চুপুটে।
অঙ্গুলি তার চলিছে যেমন
কত কী যে কথা ভাবিতেছে মন,
হেনকালে পথে ফেলিয়া নয়ন
         সহসা কবিরে হেরি
বাহুখানি নাড়ি মৃদু ঝিনি ঝিনি
বাজাইয়া দিল করকিঙ্কিণী,
হাসিজালখানি অতুলহাসিনী
       ফেলিলা কবিরে ঘেরি।
কবির চিত্ত উঠে উল্লাসি,
অতি সত্বর সম্মুখে আসি
কহে কৌতুকে মৃদু মৃদু হাসি,
         "দেখো কী এনেছি বালা।
নানা লোকে নানা পেয়েছে রতন
আমি আনিয়াছি করিয়া যতন
তোমার কণ্ঠে দেবার মতন
         রাজকণ্ঠের মালা।'
এত বলি মালা শির হতে খুলি
প্রিয়ার গলায় দিতে গেল তুলি--
কবিনারী রোষে কর দিল ঠেলি,
         ফিরায়ে রহিল মুখ।
মিছে ছল করি মুখে করে রাগ,
মনে মনে তার জাগিছে সোহাগ,
গরবে ভরিয়া উঠে অনুরাগ--
         হৃদয়ে উথলে সুখ।
কবি ভাবে, "বিধি অপ্রসন্ন,
বিপদ আজিকে হেরি আসন্ন।'
বসি থাকে মুখ করি বিষণ্ণ
         শূন্যে নয়ন মেলি।
কবির ললনা আধখানি বেঁকে
চোরা-কটাক্ষে চাহে থেকে থেকে--
পতির মুখের ভাবখানা দেখে
         মুখের বসন ফেলি
উচ্চকণ্ঠে উঠিল হাসিয়া,
তুচ্ছ ছলনা গেল সে ভাসিয়া,
চকিতে সরিয়া নিকটে আসিয়া
         পড়িল তাহার বুকে--
সেথায় লুকায়ে হাসিয়া কাঁদিয়া,
কবির কণ্ঠ বাহুতে বাঁধিয়া,
শত বার করি আপনি সাধিয়া
       চুম্বিল তার মুখে।
বিস্মিত কবি বিহ্বলপ্রায়
আনন্দে কথা খুঁজিয়া না পায়--
মালাখানি লয়ে আপন গলায়
       আদরে পরিলা সতী।
ভক্তি-আবেগে কবি ভাবে মনে
চেয়ে সেই প্রেমপূর্ণ বদনে--
বাঁধা প'ল এক মাল্য-বাঁধনে
       লক্ষ্মী-সরস্বতী।
 
                                       ১৩ শ্রাবণ  ১৩০০,  সাহাজাদপুর